কারাগারে ‘শখের বন্দিদের’ ভিড়, ফাঁসির মঞ্চে ঝোঁক
প্রবেশ পথে লম্বা লাইন। লাইনে বাবা ও মায়ের হাত ধরে শিশুরাও আছে। মুখে হাসি, উৎসাহী দৃষ্টি। সবাই প্রবেশ করছে কারাগারে। এমন দৃশ্য দেখাও বিরল।
কারারক্ষীদের চোখের দৃষ্টিও কঠোর নয়। যে কেউ ঢুকতে পারছেন। কেবল হাতে একটা সবুজ টিকেট থাকলেই হলো।
২২৮ বছর ধরে এ জায়গাটা ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। এখন নেই। গত ২৯ জুলাই কেরাণীগঞ্জে হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন ঠিকানা। এখন প্রদর্শনীর জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে পুরোনো কারাগারের ফটক। আর এ কারণেই উৎসাহী মানুষের ভিড়।
প্রদর্শনীতে গুরুত্ব পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাজীবন। একইসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে জাতীয় চার নেতার কারাজীবন। কারাগারে প্রবেশের পরই খোলা মাঠে আয়োজন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাদের সংগ্রামী ও কারা জীবন নিয়ে চিত্রপ্রদর্শনী। গতকাল থেকে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী। তা চলবে আগামী ৫ নভেম্বর পর্যন্ত।
ওমা দেখা করার জায়গা এ রকম!
ইডেন কলেজে পড়েন সাথী। বান্ধবীদের নিয়ে এসেছেন কারাগার পরিদর্শন করতে। ফটকে ঢুকেই বাম দিকে গেলেন। একটি সেমি পাকা ঘর। ঘরের একপাশে বড় বড় জানালা। জানালায় তাকালে দেখা যায় কয়েক ফুট দূরে লোহার শিক, কাঁচও আছে। এটা কীসের জায়গা? কী হতো? সাথী ও তার বান্ধবীদের প্রশ্ন। এক কারা পুলিশ এগিয়ে এলেন। এটা আসামিদের দেখা করার জায়গা। ওমা! এত দূরে থেকে কীভাবে দেখা হয়! বিস্মিত সাথী ও তার বান্ধবীরা। ‘সিনেমায় তো দেখেছি বড় বড় লোহার শিকের এপাড়ে থাকে একজন ওপাড়ে আসামি!’ কারা পুলিশ জানালেন, স্বজনদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। ফাঁসির আসামিদের ব্যাপার অন্য। কারাগারে ঢুকেই সিনেমায় দেখা কারাগারের মিল না পেয়ে একটু হতাশই মনে হলো সাথীদের!
নাজিমউদ্দিন রোডের সরু সড়ক পেরিয়ে লোহার ফটকে ঢোকার পর এমন একটি খোলামেলা জায়গা পাওয়া যাবে তা ভাবতেই অবাক লাগে। ভবনগুলো পাশাপাশি দাঁড় করানো। আর সামনে পেছনে আছে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা। কারাগারের পুরো এলাকাটা ৩৬.৭৬ একর। কিন্তু প্রদর্শনীর জন্য আসলে রাখা হয়েছে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর। অন্যসব জায়গা কেবল দূর থেকে দেখেই সন্তুষ্ট হতে হয়েছে দর্শনার্থীদের।
‘ও ভাই ফাঁসি দেয় কোনখানে?’
মধ্যবয়ষ্ক এক লোক। বাসাবো থেকে এসেছেন; নাম সাজেদুর রহমান। এদিক ওদিক যাচ্ছেন। ‘ভাই ফাঁসি দেওয়া হয় কোনখানে? ফাঁসির মঞ্চটা কোথায়?’ ফটকে ঢোকার পর একটা বড় ছবি দেওয়া আছে। ফাঁসির মঞ্চের ছবি। সেখানেই অনেক ভিড়। অনেকে ওই ছবিরই ছবি তুলছেন। কেউ ওই ছবির সামনে দাঁড়িয়েই সেলফি তুলছেন। জানা যায়, ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। সেখানে কিছু সংস্কারকাজ বাকি আছে। সেসব সম্পন্ন হওয়ার পরই প্রদর্শনীর জন্য খুলে দেওয়া হবে ফাঁসির মঞ্চ। এক কারারক্ষী জানালেন, দর্শনার্থীরা সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন এটাই করছেন। অনেকেই ফাঁসির মঞ্চ দেখতে আগ্রহী।
তবে কারাগারের বাইরে অনেক নাম পরিচিত। প্রবেশের পর সেসব চোখে পড়ল। যেমন আমদানি, কেস টেবিল, সেল, মেন্টাল এসব চোখে পড়ল।
আছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন এ কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাঁর ব্যবহৃত সেলকে বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। সেলটি খুব বেশি বড় নয়। সেলের বাইরে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে আছে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লাগানো কামিনী ফুল ও সফেদা গাছ। জাদুঘরে আছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত নামাজের চৌকি, পুরোনো কাপড়, ময়না পাখির খাঁচা, বিছানাপত্র, খাবারের টিনের থালা, পড়াশোনার টেবিল, চায়ের কাপ ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু স্নানের ঘর এবং রান্নাঘরটিকেও সংরক্ষণ করা হয়েছে।
২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লোহার শিকে বুলেটের আঘাত
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আটক করা হয় জাতীয় চারনেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী ও আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই আলাদা একটি সেলে চারজনকে রাখা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ওই কারাগারেই তাঁদের গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। লোহার শিকে বুলেটের আঘাতগুলো আজও স্পষ্ট।
ওই সেলের ভেতরটা খোলামেলা। আছে পড়ার টেবিল, নেতাদের ব্যবহার করা চৌকি। সেলের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে চার নেতার আবক্ষ মূর্তি। স্থানীয় একটি স্কুলের ছাত্র সিদ্দিক তাঁর বন্ধুদের নিয়ে এসেছে কারাগার দেখতে। এরা কারা? এ প্রশ্ন করতেই সিদ্দিকের পাল্টা প্রশ্ন! ‘কী বলেন? তাজউদ্দিন আহমেদকে চেনেন না? আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। আর ইনি মনসুর আলী। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাবা।’
সেল থেকে বের হওয়ার চোখে পড়ল পাকা একটি জায়গা। লাল-সবুজ রঙে রাঙানো। এখানে হত্যার পর জাতীয় চার নেতার লাশ রাখা হয়।
‘কেমন ভেতরটা দেখতে ইচ্ছে করত’
হুইল চেয়ারে করে কারাগার দেখতে এসেছেন আমির আলী। দয়াগঞ্জে থাকেন। আমির আলী বলেন, ‘এদিক দিয়ে গেলেই খুব ইচ্ছে হতো বড় দেওয়ালের ওই পাশে কী হয় তা জানার। ভেতরের মানুষগুলো কেমন, কী অবস্থায় থাকে তা জানতে ইচ্ছে করত। এজন্যই এসেছি।’ কী দেখলেন? আমির আলী বলেন, ‘ভেতরের কামরাগুলো দেখলে ভালো হইতো।’
কিছু বিক্ষিপ্ত সাধারণ কামরা দেখা যায় কাছ থেকে। এমনই একটি কামরার ভেতরে বড় বড় করে লেখা সম্রাট। কে জানে কে কবে নিজের নামটি ময়লা সাদা দেয়ালে লিখে রাখে! এখন ওই সম্রাট কোথায় আছে সেটাই বা কে জানে! লাল-সাদা দালানগুলো যে কতকিছুর সাক্ষী!