সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি
সদ্য অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যায় না বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আজ সোমবার টিআইবির রাজধানীর ধানমণ্ডিতে নিজস্ব কার্যালয়ে এ-সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম। একই সঙ্গে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনী আইনের সংস্কার ও হালনাগাদের সুপারিশ করা হয়েছে।
‘ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১৫ : প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবি জানায়, নির্বাচনে অধিকাংশ প্রার্থী বিভিন্নভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। প্রার্থীরা নির্বাচনের জন্য অনুমোদিত সীমার তিনগুণের বেশি ব্যয় করেছেন। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় ভূমিকার অভাব, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাবের ঘাটতির কারণে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।urgentPhoto
টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেজাউল করিম বলেন, সিটি নির্বাচনে ব্যাপক হারে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন হয়েছে এবং তা প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশনের (নিক) ব্যর্থ হয়েছে।
অনুষ্ঠানে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, আইনে নির্দলীয় নির্বাচনের কথা বলা হলেও বাস্তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এই দ্বৈততার কারণেই নির্বাচনে নানা অনিয়ম দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী আইনটি পরিবর্তন করে দলীয় করা যেত পারে, যাতে দলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ মনোনয়ন না পায়। এতে আর্থিক অনাচার ও অনিয়মের সুযোগ কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া এই নির্বাচনে সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদ ছাড়া সাধারণ আসনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না জানিয়ে শামসুল হুদা বলেন, এটি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রবর্তনেরও দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুমোদিত নির্বাচনী ব্যয়ের তুলনায় সাত, ১১ বা ২১ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। নির্বাচনীবিধি লঙ্ঘন করে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
অতিরিক্ত ব্যয়
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থীদের ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত ছিল ৫০ লাখ টাকা। তবে এর বাইরে গিয়ে তিন মেয়র প্রার্থী ২০ লাখ থেকে তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন। ঢাকা দক্ষিণের তিনজন মেয়র প্রার্থী অনুমোদিত ৩০ লাখ টাকার সীমার বিপরীতে এক কোটি ৪৬ লাখ থেকে তিন কোটি ৫১ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন। অন্যদিকে, চট্টগ্রামের তিনজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ ছয় কোটি ৪৭ লাখ থেকে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ের চিত্র দেখা গেছে। এখানে অনুমোদিত ব্যয়ের সীমা ছিল ৩০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীরা ঢাকায় গড়ে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৫ লাখ টাকা এবং ৮ দশমিক ২৬ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রামে যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৫৮ লাখ এবং ১১ দশমিক ৫২ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হলফনামা অনুযায়ী মেয়র প্রার্থীরা মাসে ৪ দশমিক ৫৬ লাখ থেকে ১ দশমিক ২২ কোটি, কাউন্সিলরা সাত লাখ ৪৭ হাজার থেকে ৭১ দশমিক ৫০ লাখ এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলরা পাঁচ লাখ থেকে সাত লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন বলে তথ্য রয়েছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘন
নির্বাচনে অতিরিক্ত ব্যয় ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ক্যাম্পে পানীয় ও খাদ্য পরিবেশন, বকশিশ, নির্ধারিত সময়ের বাইরে মাইকিং, ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রচারণা, মনোনয়নপত্র দাখিল করতে যাওয়ার সময় যানবাহনসহ শো-ডাউন, আলোকসজ্জা, টি-শার্ট দেওয়া ইত্যাদি।
সমর্থন পেতে উৎকোচ
নির্বাচনে বিভিন্ন দলের সমর্থন পেতে চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থীরা ২০ লাখ টাকা থেকে সাত কোটি টাকা পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, দলীয় তহবিল এবং ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতাদের দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে এই অবৈধ অর্থ প্রদানে প্রার্থী নিজে ছাড়াও অর্থদাতা হিসেবে স্থানীয় ঠিকাদার, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের একাংশ জড়িত ছিলেন। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীরা উভয় ক্ষেত্রেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছেন।
নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে দোদুল্যমনতা, প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনে সমানভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যর্থতা, ভোট জালিয়াতি, কারচুপি এবং ভোটকেন্দ্র দখলে সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারায় নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করেছে টিআইবি। সংস্থাটি বলছে, স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ও সংসদ সদস্যদের প্রভাব বিস্তারের কারণে সামগ্রিকভাবে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যায় না।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন উপনির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসানসহ অন্যরা।
গবেষণার জন্য তিন সিটির ১৩৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নমুনা এলাকা নির্ধারণ করে মোট নয়জন মেয়র এবং ১০১ জন সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীকে বেছে নেওয়া হয়। তবে এই গবেষণার পর্যবেক্ষণ সব প্রার্থী ও কেন্দ্রের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয় বলেও জানিয়েছে টিআইবি।
গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ভোটগ্রহণ করা হয়। তিন সিটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় লাভ করেন।