সাঁওতালদের ধান, ‘হুট করেই’ কাটছে প্রশাসন
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ আখ খামারের জমিতে সাঁওতালদের চাষ করা ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে সাঁওতালরা নন, প্রশাসনের সহযোগিতায় এই ধান কাটতে শুরু করেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ।
আজ দুপুর ১২টা থেকে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে সাহেবগঞ্জ আখ খামারে ধান কাটা শুরু হয়। এ সময় গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হান্নান।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শফিকুল ইসলাম বলেন, ধান কাটা পর্যবেক্ষণ ও সুষ্ঠু বণ্টনের বিষয়সহ সার্বিক বিষয়ে নজরদারি রাখতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত আছেন। তবে কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে নেওয়া, মামলা প্রত্যাহারসহ সাঁওতালদের পক্ষ থেকে কিছু দাবি দাওয়া রয়েছে। পরে সাঁওতাল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ধান বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
এ বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার সাঁওতালদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সাহেবগঞ্জ এলাকার আনুমানিক ১৩০ থেকে ১৩৫ একর জমিতে সাঁওতালরা ধান রোপণ করেছিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৯০০ একর জমিতে তাঁরা বসতি স্থাপন করেছিলেন। অবশ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ৪৫ একরের মতো জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে।
সাঁওতালরা যে ধান বপন করেছেন, গত ১৭ নভেম্বর এক আদেশে তা তাঁদের কেটে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালত সাঁওতালদের স্বাভাবিক চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বলেন। এ ছাড়া তাঁদের ওপর হামলার ঘটনায় কী কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, হাইকোর্ট সাঁওতালদের রোপণ করা ধান কাটতে সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ৩০ তারিখের মধ্যে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি ও মূল ঘটনা জানিয়ে প্রশাসনকে একটা প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদেশে কোথাও এটা বলা হয়নি যে, এ সময়ের মধ্যে ধান কেটে তারপর প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
এই আইনজীবীর দাবি, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাঁওতালদের এটা বুঝিয়েছেন যে, ৩০ তারিখের মধ্যেই ধান কেটে নিতে হবে। এ সময় সাঁওতালরা জানিয়েছেন যে, কিছু ধান এখনো পাকেনি। সেগুলোতে পানি দেওয়ার অনুমতি চান তাঁরা। কিন্তু যেহেতু শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ওই এলাকায় পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন রয়েছে, সেহেতু সেখানে ধান কাটতে বা পানি দিতে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন স্থানীয় সাঁওতালরা। তাদের আশঙ্কা ছিল, ধান কাটতে গেলে আবারও তাদের ওপর গুলি চালানো হবে। এমনকি আজ সকালে স্থানীয় বাম দলগুলো ধান কাটার জন্য কাস্তেসহ অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহও করেছিলেন সাঁওতালদের। এই ভয়ের কথা ইউএনওকে জানালে তিনি সাঁওতালদের জানান যে, বিষয়টি তিনি দেখছেন। অবশ্য এর পরপরই মেশিন দিয়ে ধান কাটা শুরু করে মিল কর্তৃপক্ষ।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যেসব ধান পেকে নুয়ে পড়েছে, সেগুলো মেশিনে কাটা সম্ভব নয়। ফলে সেগুলো মেশিনের নিচে পড়ে নষ্ট হবে। আর কাঁচা ধান মেশিনে কাটা হলে কোনো কাজে আসবে না। তাই শেষ পর্যন্ত সাঁওতালরা কিছুই না পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রায় একই কথা জানান সাঁওতালদের পক্ষে হাইকোর্টে রিট করা সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) আইনজীবী অবন্তী নূর। এনটিভি অনলাইনকে তিনি জানান, ধান কাটা শুরুর খবর পেয়ে স্থানীয় ইউএনও এবং মিলের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
অবন্তী নূর বলেন, সকালে সাঁওতালরা ধান কাটতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার যে ফটক, সেটি মাঠ থেকে এক কিলোমিটার দূরে। ফলে তাঁরা প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিলেন কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে নিতে, যাতে করে কোনো একটি বাহনের মাধ্যমে তারা ধানগুলো বের করতে পারেন। কিন্তু তাঁদের এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি প্রশাসন। এ ছাড়া চারপাশে মোতায়েন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় সব মিলিয়ে তাঁরা ধান কাটতে পারেননি।
চিনিকল কর্তৃপক্ষ ধান কাটার পর তা কীভাবে সাঁওতালদের মধ্যে বিতরণ করবে, সে বিষয়ে স্থানীয় ইউএনওর কাছেও জানতে চান অবন্তী। ইউএনও জানিয়েছেন, বিষয়টি মিল কর্তৃপক্ষ জানে। একই প্রশ্ন মিল কর্তৃপক্ষকে করা হলে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসককে জানিয়েছেন, বিষয়টি প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে।
এই আইনজীবী বলেন, অর্থাৎ এই ধান কাটা এবং এর বিরতণ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা বা সমন্বয় নেই মিল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের। কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়েই হুট করেই ধান কাটা শুরু হয়েছে। এমনকি সাঁওতালদের কমিটি বা কারা ধান পাবেন, সে বিষয়ে কোনো তালিকাও নেই প্রশাসনের কাছে। তাই এসব ধান নষ্ট হবে বা যথাযথ ব্যক্তি পাবেন না বলে আশঙ্কা অবন্তী নূরের।