পিলখানা হত্যাকাণ্ড : আদালতে কাটল ১৩ বছর, চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষা
পিলখানা ট্র্যাজেডির এক যুগ পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি বিচারপ্রক্রিয়া। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়ের পর আপিল বিভাগে ঝুলে আছে হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়। একই ঘটনায় বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম পেরোতে পারেনি বিচারিক আদালতের গণ্ডি। নিম্ন আদালতে বিচার চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বিস্ফোরক মামলাটি বিচারাধীন থাকায় যাঁদের সাজা ১০ বছর বা তারও কম, তাঁরাও মুক্তি পাননি, পাননি জামিন।
২০০৯ সালে তৎকালীন বিডিআর সপ্তাহ চলাকালে ২৫ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন বাহিনীর কয়েকশ সদস্য। তাঁদের হাতে পিলখানা সদর দপ্তরে নিহত হন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন।
পরে সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহীদের আলোচনা শেষে পর দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি অস্ত্র, গুলি ও গ্রেনেড জমাদানের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়।
ঘটনার জেটপাট ও বিদ্রোহের এ ঘটনায় মোট ৫৮টি মামলা দায়ের করা হয়।
২০১৩ সালে বিডিআর বিদ্রোহের ৫৭টি মামলার বিচার বাহিনীর নিজস্ব আদালতে শেষ হয়। সেখানে ছয় হাজার জোয়ানের কারাদণ্ড হয়। বিদ্রোহের বিচারের পর পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার শুরু হয় সাধারণ আদালতে। ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে দেওয়া রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আড়াই শতাধিক অপরাধীকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
পরে এই মামলার ডেথ রেফারেন্স, আপিল শুনানি শেষে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায় দেন হাইকোর্ট। সেখানে বলা হয়, ওই ঘটনা ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তা-ই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা।
হাইকোর্টের রায়ের তিন বছর পর ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেও ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি তোলার খরচ, অনুলিপি পাওয়ার প্রক্রিয়া, আপিলের পেপারবুক তৈরি, আদালতে সেই পেপারবুক রাখার স্থান, চূড়ান্ত বিচারের সময়সহ বিচারিক প্রক্রিয়ার নানা কারণে আপিল শুনানি শুরু হতে দেরি হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল, লিভ টু আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে। রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের প্রত্যাশা চলতি বছরেই মামলাটির আপিল শুনানি শুরু হবে।
এ মামলায় হাইকোর্টে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম মামলার অবস্থা সর্ম্পকে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় বিচারিক কাজ দুই ধাপ পেরিয়ে এখন চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এ ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে করা মামলাটি এখনও সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে। হত্যা মামলায় তিনশ’র মত আসামি। যাঁদের ১০ বছর বা তারও কম সাজা হয়েছে তাঁরা সাজা খেটে মুক্তির অপেক্ষায় আছে। কিন্তু বিস্ফোরক মামলাটি বিচারাধীন থাকায় এবং সেখানে তাঁরা জামিন না পাওয়ায় তাঁদের মুক্তি হচ্ছে না।’
অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘১৩ বছর ধরে আসামিরা জেল খাটছেন। এটা অমানবিক। বিস্ফোরক মামলাটি বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে বিচার শেষ হতে আরও ১০ বছর লাগতে পারে।’
আমিনুল বলেন, ‘বিচারিক আদালতে আমরা বার বার দরখাস্ত দিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করেছি, জামিন চেয়েছি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না। এতে বিচারের নামে প্রহসন হচ্ছে। বিচারকে দীর্ঘায়িত করা হলে তা অন্যায় হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়।’
হত্যা মামলার চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তি বিষয়ে এ আইনজীবী বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে ৮২ জনের পক্ষে আমি আপিল ফাইল করেছি। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১০২ জনের পক্ষে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) ফাইল করেছি। এ আপিলগুলো এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে। এটি এখন মাননীয় প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার।’
আলোচিত এ মামলায় মৃত্যদণ্ড এবং যাবজ্জীবন মিলিয়ে একশ’র বেশি আসামি আপিল ফাইল করেননি বলে জানান তিনি।
পিলখানায় অর্ধশতাধিক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ড মামলার ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ রায়ে যাঁরা খালাস পেয়েছেন এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে যাঁদের যাবজ্জীবন হয়েছে, এ রকম প্রায় ১০০ আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ৩১টি লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সব মিলিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত দুই পক্ষের ৮২টি আপিল ও ১৩৩টি লিভ টু আপিল করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন এনটিভি আনলাইনকে বলেন, ‘আসামিদের আপিল সম্পন্ন হলেও তাঁরা এখনো আপিলের সারসংক্ষেপ দেননি। ফলে বলা যাচ্ছে না, আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত। আসামিপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ দিলেই শুনানি শুরুর সম্ভাবনা তৈরি হবে।’
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায়ের দৈর্ঘ্য এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ রায়।