বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন অসম্ভব : মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্যমাত্রা ইতিবাচক নয়। নানান ধরনের চাপ আছে। এ অবস্থায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ মনে হয়নি। এসব লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন একেবারে অসম্ভব। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়–কোনোটিই বাস্তবায়নযোগ্য মনে হয়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১ জুন) জাতীয় বাজেট পেশের পর সংবাদমাধ্যমে পাঠানো লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে বাজেটের আকার মোটেই বড় নয়। জিডিপির আনুপাতিক হারে বাজেট ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। এটি পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্ন। কিন্তু আকার ছোট হলেও বাস্তবায়ন বড় সমস্যা। এ বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাড়লেও ১০ মাসে বাস্তবায়ন ৫০ শতাংশের কিছুটা বেশি। এ অবস্থায় এডিপির আকার বাড়ানো হয়েছে। ফলে এটি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, তা সন্দেহ রয়েছে। রাজস্ব আহরণে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। কয়েক বছরে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। তবে, সাম্প্রতিক হ্রাসের হার কিছু কমে আসছে। কয়েক বছর আগে এক দশমিক আট শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমে আসছিল। বর্তমানে তা আরও কম হারে কমছে। অন্যদিকে করোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এ কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো জরুরি। কিন্তু ওইভাবে বাড়েনি। বাজেট ঘাটতি জিডিপির পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। এটি আরও বাড়লেও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো হয়েছে। এটি ভালো পদক্ষেপ নয়। তবে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার নিচে রয়েছে। ফলে সরকার ব্যাংক থেকে এত ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে।’
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এতে বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা পূরণ হবে না। বলা হয়েছে, জিডিপির ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ হবে। এটিকে অবাস্তব বললেও উদার বিশ্লেষণ হবে। এটি একেবারে অসম্ভব। কারণ, কয়েক বছর পর্যন্ত জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ হয়নি। এর মধ্যে এবার হঠাৎ কীভাবে ২৭ শতাংশ হবে। এখানে দুটি বিষয়। প্রথমত, লক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ না। দ্বিতীয়ত, বাস্তবায়নের সক্ষমতাও কম। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ। এটি উচ্চাভিলাষী। কারণ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটিও অবাস্তব। কারণ, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। ফলে মূল্যস্ফীতি কমার খুব একটা লক্ষণ দেখছি না।’
বাজেট বাস্তবায়নে আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই উল্লেখ করে মির্জ্জা আজিজুল বলেন, ‘এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু প্রতিবছর দেখা যায়, আয়-ব্যয়ের যে লক্ষ্য থাকে, সংশোধিত বাজেটে এর চেয়ে কমানো হয়। বাস্তবায়ন হয় এর চেয়ে আরও কম। বর্তমানে যে পরিমাণ টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) রয়েছে, কর দেয় এর চেয়ে অনেক কম। এক্ষেত্রে টিআইএনধারীদের কর নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে ভ্যাটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দোকানদাররা ভ্যাট দিতে চান না। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। ক্রেতারাও রসিদ নিতে আগ্রহী নন। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন। ইতোমধ্যে তারা করের আওতায় এসেছেন। তাদের কর নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে।’
মির্জ্জা আজিজুল বলেন, ‘এডিপিতে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। যার ফলে প্রকল্পগুলোয় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। প্রকল্প বরাদ্দের ক্ষেত্রে যে সময়সীমা দেওয়া হয়, পরে সময় বাড়ে। এতে ব্যয়ও বেড়ে যায়। এ বছর সরকার প্রকল্প কমানোর কথা বলছে। কিন্তু এরপর কিছু অনুমোদিত প্রকল্প এডিপিতে ঢুকে যায়। সবকিছু মিলে এডিপির জন্য আমাদের আরও বাস্তবধর্মী হওয়া উচিত। সামাজিক খাতগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুই খাতে জিডিপির অনুপাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা আশপাশে যেকোনো দেশের চেয়ে কম। তবে খরচের দিক থেকেও সমস্যা রয়েছে। কারণ, প্রতিবছরই এ খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা অব্যবহৃত থাকে। ফলে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।’