প্রাথমিক পর্যায়ে রক্ত পরীক্ষাতে শনাক্ত সম্ভব লিভার ক্যানসার : গবেষণা
সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে লিভার ক্যানসার শনাক্ত সম্ভব বলে জানিয়েছে একটি গবেষণা। আজ রোববার (২৩ জুলাই) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সেমিনারে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে লিভার ক্যানসার শনাক্তকরণ’ শিরোনামে ওই সেমিনারেটি পিয়ার রিভিউড আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার কমিউনিকেশন্সে প্রকাশিত নিবন্ধের ভিত্তিতে আয়োজন করা হয়। এইচকেজি এপিথেরাপিউটিক্স লিমিটেড, আইসিডিডিআরবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের কয়েকজন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাটি সম্মিলিতভাবে করেছেন।
নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, এই পরীক্ষা সুনির্দিষ্ট ডিএনএ মিথাইলেশন সিগনেচার পদ্ধতিতে লিভার ক্যানসার নির্ণয় করতে সক্ষম। এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে ঝুঁকিতে আছে এমন ব্যক্তিদের (যেমন লিভারের রোগ, টাইপ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং অ্যালকোহল গ্রহণকারী) লিভার ক্যানসার শনাক্তকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। ফলশ্রুতিতে এই ধরণের ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার অনেকাংশে কমে আসবে।
এইচকেজি এপিথেরাপিউটিকস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং কানাডার রয়্যাল সোসাইটির ফেলো প্রফেসর মোশে জিফ সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আলোচনায় ছিলেন অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব ও আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ডা. ওয়াসিফ আলী খান।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমীদ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ডিজিএইচএসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) ডা. রফিক-উস-সালেহীন ও সহকারী পরিচালক (প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেসন) ডা. আফসানা আলমগীর খান।
আজ বিকেলে আইসিডিডিআরবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, লিভার ক্যানসারের ব্যাপকতা বিশ্বের সব দেশেই দেখা যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ দেরিতে শনাক্ত হয়। ফলে এই রোগের চিকিৎসা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, যা রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। উদ্ভাবিত এই পরীক্ষা আধুনিক সিকোয়েন্সিং ও মাল্টিপ্লেক্সিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সাধারণ টিস্যু, রক্তের অন্যান্য নমুনা ও নন-লিভার ক্যানসার টিউমার থেকে লিভার ক্যানসার নমুনাকে আলাদা করে প্রচলিত রোগ নির্ণয় পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারে।
আরও বলা হয়, ৫৫৪ জন অংশগ্রহণকারীকে গবেষণার আওতায় এনে এই পরীক্ষাটির মূল্যায়ন করেছেন গবেষকরা। এর মধ্যে ছিল লিভার ক্যানসার রোগী, নন-লিভার ক্যানসার রোগী, ক্রনিক হেপাটাইটিস-বি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও সুস্থ ব্যক্তি। ফলাফল হিসেবে পরীক্ষাটিতে লিভার ক্যানসার শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ৮৪ দশমকি পাঁচ শতাংশ সেনসিটিভিটি ও ৯৫ শতাংশ স্পেসিফিসিটি দেখা গেছে। এই গবেষণা ফলাফল প্রাথমিক পর্যায়ে লিভার ক্যানসার রোগের শনাক্তের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা তৈরি করেছে (এটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের আওতাভুক্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রেজিস্ট্রি হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে)।
বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আজকের সেমিনারটি লিভার ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য একটি মাইলফলক এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনন্য অগ্রগতিকে তুলে ধরেছে। আমরা সবাই এখানে লিভার ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে একত্রিত হয়েছি। বিশেষ ডিএনএ চিহ্নিতকারীর ওপর ভিত্তি করে এই নতুন পরীক্ষা ঝুঁকিতে আছে এমন মানুষদের সাহায্য করার পাশাপাশি ক্যানসারের প্রভাব কমিয়ে আনবে বলে আমি আশা করছি।’
অধ্যাপক মোশে জিফ বলেন, ‘উন্নত এই পরীক্ষাটি ক্যানসার শনাক্তকরণে একটি নতুন সম্ভাবনার পথ তৈরি করেছে। এটি ক্যানসার রোগ নির্ণয় এবং রোগীর স্বাস্থ্যের অবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনাসহ প্রাথমিক পর্যায়ে লিভার ক্যানসার শনাক্তকরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।’
বিএসএমএমইউয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব বিএসএমএমইউ থেকে এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যদিও আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবুও লিভার ক্যানসারের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের এই অগ্রগতি একটি বিরাট পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সেইসঙ্গে এটি লিভার ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের ওপর রোগের প্রভাবকে অনেকাংশে কমিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।’
গবেষণার সমন্বয় আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ডা. ওয়াসিফ আলী খান বলেন, ‘এই যুগান্তকারী অগ্রগতি লিভার ক্যানসার শনাক্তকরণে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে এটির সম্ভাবনা অসাধারণ। এর মাধ্যমে ক্যানসার নির্ণয়সহ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে আমাদের দলের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেছে। লিভার ক্যানসারের ব্যাপকতা কমাতে এবং দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে বাংলাদেশে এই পরীক্ষা কার্যকরি ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।’