২১ আগস্ট ট্র্যাজেডিতে নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যরা ভালো নেই
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের চার জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। ২১ আগস্ট ট্র্যাজেডিতে নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যরা ভালো নেই। হামলার মামলার দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন নিহত ও আহতদের পরিবার।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের নিহত চার জন হলো রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগনেতা নিহত লিটন মুন্সি, একই উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামের সুফিয়া বেগম, কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামের নাছিরউদ্দিন ও ক্রোকিরচর গ্রামের যুবলীগনেতা মোস্তাক আহাম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু।
রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগনেতা নিহত লিটন মুন্সির বাড়িতে গিয়ে রোববার (২০ আগস্ট) দেখা গেল বৃদ্ধ বাবা আইয়ুব আলী মুন্সী ও মা আছিয়া বেগম ছেলের শোকে শোকাহত হয়ে আছেন। ২১ আগস্ট ছেলের নিহতের কথা তারা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।
নিহত লিটন মুন্সির মা আছিয়া বেগম বলেন, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজ আমরা বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছি। লিটনের বাবা ও আমি দুজনেই বয়স্ক মানুষ। আমরা প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকি। লিটনের বাবা এখন কোন কাজ করতে পারে না। আমি অপারেশনের রোগী। মাসে আমার ওষুধ লাগে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার। ভাতা পাই তিন হাজার টাকা। খুবই কষ্টে দিন যাপন করছি।
গ্রেনেড হামলায় আহত রামকৃষ্ণ মণ্ডল মাদারীপুর সদর উপজেলা ছিলারচর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী। ঘটনার দিন তিনি শেখ হাসিনার ভাষণ শুনতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে উপস্থিত হন। এক পর্যায় গ্রেনেড হামলায় অনেকের সাথে তিনিও আহত হন। তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে সেখান থেকে পাঠানো হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। দীর্ঘদিন সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। এক চোখ নষ্ট হয়ে যায় গ্রেনেডের আঘাতে।
রামকৃষ্ণ মণ্ডল জানান, হাসপাতালে আমি অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। কিন্তু প্রতিদিন পুলিশ এসে আমাকে জেরা করতো। আমি কোন পার্টি করি, কেন ওখানে গিয়েছি? এমন নানা ধরনের প্রশ্ন করে। আমাকে হুমকিধমকি দেয়। আমি তখন বলতেও পরিনি আমি আওয়ামী লীগ করি। সেই হামলায় আমার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। নিজের খরচেই চিকিৎসা করাই। কেউ আমাকে এক পয়সাও সহযোগিতা করেনি। এখনও কষ্ট করে মিস্ত্রী কাজ করে আমার সংসার চালাই। চোখ নষ্ট হওয়ার কারণে ঠিকমতো কাজও করতে পারি না। আমি যেহেতু শেখ হাসিনার মিটিংয়ে গিয়ে চোখ হারিয়েছি, তাই দাবি করছি শেখ হাসিনা যেন আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়।
গ্রেনড হামলায় নিহত নাসিরের বড় ছেলে মাহাবুব হোসেন (২৪) জানান, বাবার উপার্জনেই চলতো সংসার। বাবার মৃত্যুর পর টাকার অভাবে আমাদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন কোনদিন অর্ধপেট আবার কোনদিন খাবারই জোটেনি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এখন সেই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে আমার মা, আমি আর আমার ভাই নাজমুলকে নিয়ে কোনরকম বেঁচে আছি। এ ছাড়া আমাদের খবর আর কেউ রাখেনি।
গ্রেনেড হামালায় নিহত যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহাম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর। সে বরিশালের মুলাদি নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। এ কারণেই তার লাশ মুলাদিতেই দাফন করা হয়। কথা হয় সেন্টুর স্ত্রী আইরিন সুলতানার সাথে। তিনি ঢাকার মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। এক মেয়ে আফসানা আহমেদ হৃদিকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তিনি বলেন, এমন দুঃখজনক স্মৃতি কি ভোলা যায়, না মুছে যায়। মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিলাম। সে সম্বল আর চাকরি থেকে যা পাই, তা দিয়েই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। তিনি ঢাকায় একা থাকেন। মহিলা মানুষের একা থাকার বিড়ম্বনা উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যদি মৃতদের পরিবারের জন্য একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে উপকৃত হতাম।
আহত হালান হাওলাদার বলেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর স্প্লিন্টার রয়েছে। স্প্লিন্টার জ্বালা-যন্ত্রণা অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে। হাঁটাচলা করতে খুব কষ্ট হয়। সে কারণে তেমন কাজ করতে পারি না। তারপরেও সংসারের খরচ মেটানোর জন্য ফেরি করে মুরগি বিক্রি করি। আমরা যারা আহত আছি প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো তা হলে ভালো হতো। আহত অনেকে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে প্রতি মাসে ভাতা পায়। আমি ভাতা পাই না। প্রধানমন্ত্রী যেন আমাদের কালকিনির আহত তিন জনের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। আহত অনেকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ফ্লাট পেয়েছে। আমি ফ্লাট পাইনি। আমার থাকার জন্য স্থায়ী বসত ঘরের প্রয়োজন।
আহত কবির হোসেন বলেন, গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে বাম হাতের পাঁচ আঙুল বাঁকা হয়ে আছে। এ হাত দিয়ে কোন ভারী কাজ করতে পারি না। দুই বার আমি মাত্র এক লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে যে টাকা দিয়েছে আমি সে টাকা পাইনি। তখন আমি টাকা রোজগারের জন্য মালয়েশিয়া ছিলাম। বিদেশে গিয়েও হাতের সমস্যার কারণে তেমন কাজ করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে দেশে চলে আসি। এখন বেকার জীবন যাপন করছি। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে যে এককালীন টাকা দিয়েছে আমাকেও যেন সে টাকা দেয়। প্রতিমাসে যেন ভাতার ব্যবস্থা করেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাই।
কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের আহত সাইদুল হক সরদার বলেন, শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য আস্তে আস্তে মঞ্চের ১০ থেকে ১২ হাত দূরত্বে চলে আসি। দাঁড়িয়ে মন দিয়ে নেত্রীর বক্তব্য শুনতে থাকি। বক্তব্য প্রায় শেষ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেননি তার মধ্যে বোমা ফাটানোর শব্দ। সে ঘটনায় আহত হয়ে শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে জীবন-যাপন করছি। শরীরে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় তেমন ভারী কাজ করতে পারছি না। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলে উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমি উন্নত চিকিৎসা কীভাবে করবো। এত টাকা পয়সাতো আমার নেই। ছোট একটা চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, তিনি যেন আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।