ভৈরবে দিন দিন বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দিন দিন বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। তাদের অনিয়ন্ত্রিত বেপরোয়া আচরণ ও কাজে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী, ব্যবসায়ী সমাজসহ খোদ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরাও। উঠতি বয়সী এইসব কিশোরদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না, আবার নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে অভিভাবকসহ প্রশাসনের লোকেরা হিমশিম খাচ্ছেন।
সরেজমিনে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত ৬ মাসে এই পৌরশহরে ১১টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়েছে কিশোর গ্যাং। আর এসব সংঘর্ষে পুলিশসহ আহত হয়েছে কমপক্ষে দুই শতাধিক লোক। এসব ঘটনায় ৫৭৪টি বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। যাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।
এসব সংঘর্ষ চলাকালে নিরপরাধ ও নির্দোষ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অযথা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের প্রতিবাদে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা গত ১৩ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুর্জয়মোড় এলাকায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেন।
পরে প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেন। যার অনুলিপি প্রদান করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর মেয়র বরাবর।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ জুলাই রাতে পায়ে পা লাগাকে কেন্দ্র করে শহরের ভৈরবপুর এলাকার খালেক মিয়ার বাড়ি ও কামাল মিয়ার বাড়ির লোকজনের মাঝে সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ২৫ জন আহত হয়। ভাঙচুর হয় ৪০টিরও বেশি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০ লাখ টাকারও বেশি বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্তদের।
গত ২৪ ও ২৫ জুলাই শহরের ঘোড়াকান্দা ও পঞ্চবটি এলাকার যুবকদের ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়। সংঘর্ষে ঘোড়াকান্দার লোকজন পঞ্চবটি এলাকার ১৫-২০টি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে।
এক রিকশাচালককে মারধর করায় ৬ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত ১০টার দিকে ভৈরব পৌর শহরের আলিম সরকারের বাড়ি ও বাউড়ার বাড়ির কিশোরদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। এ সময় অর্ধশতাধিক দোকানপাটে ভাঙচুর ও লুটপাট হয় বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
২৭ জুন সোমবার বিকেলে শহরের দক্ষিণ চণ্ডিবের এলাকার মোল্লাবাড়ি ও বেপারিবাড়ির দুইদল কিশোরের মাঝে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ১৫ জনের মতো আহত হয়। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বাক-বিতণ্ডা নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এই ঘটনায় প্রায় শতাধিক বাড়িঘর দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
গত ২২ জুন (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টার দিকে শহরের কমলপুর সরকারবাড়ি ও গাছতলাঘাট নার্সারিপাড়ার কিশোরদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে আহত হয় প্রায় ৩০ জন। ৫০টির মতো দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ২১ জুন (বুধবার) স্থানীয় একটি স্কুলের শ্রেণিকক্ষে এক শিক্ষার্থীকে শিক্ষক শাসন করার সময় অন্য এক শিক্ষার্থীর হাসিকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষ হয়।
৩ জুন (শনিবার) রাতে শহরের ভৈরবপুর উত্তরপাড়া ও দক্ষিণ চণ্ডিবের এলাকার কিশোরদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ডাব খাওয়াকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত। এতে পৌর ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পুলিশসহ ৪০ জন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দুই রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় একটি স্কুল ক্যান্টিনসহ ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
২৫ এপ্রিল শহরের জগন্নাথপুর এলাকায় রেললাইনের পাশে লেবুবাগান থেকে লেবু পাড়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। এতে ১০ জন আহত হয়। ভাঙচুর হয় ১০টিরও বেশি দোকানপাট।
২৪ এপ্রিল সোমবার জগন্নাথপুর গাইনহাটি এলাকার মিঠু (১৫) নামের এক কিশোর বন্ধুদের নিয়ে একই এলাকায় রেললাইনের পাশে ছবি তুলতে যায়। এসময় স্থানীয় কিশোরদের সাথে তারা মারামারিতে লিপ্ত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় ১৫ জন, ভাঙচুর করা হয় চারটি দোকান। ৯ এপ্রিল রোববার রাতে শহরের পঞ্চবটি বউবাজার এলাকায় একজনের পায়ে গোবর লেগেছে দেখে আরেকজন হাসি দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপে সংঘর্ষে আহত হয় ২০ জন। ৫০টিরও বেশি দোকানপাটে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
১১ মার্চ শনিবার সন্ধ্যায় ভৈরবপুর উত্তরপাড়া আলিম সরকারের বাড়ির সাথে ভৈরবপুর দক্ষিণপাড়া বাউরার বাড়ির কিশোরদের সংঘর্ষ হয়। ১০ মার্চ শুক্রবার বিকেলে ভৈরবপুর উত্তরপাড়ার আলিম সরকার বাড়ির একজনের সাথে বাউরার বাড়ির এলাকার কয়েকজনের মোটরসাইকেলের সাইলেন্সারের বিকট শব্দ নিয়ে বাক-বিতণ্ডা থেকে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে ৩৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ও ১২ রাউন্ড শিসা বুলেট নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। সংঘর্ষে রাস্তার পাশে থাকা ১৮ থেকে ২০টি দোকান ভাঙচুর করা হয়। আহত হয় ২০ জন।
৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরের ভৈরবপুর উত্তরপাড়ার ছাবর আলী হাজী ও আলীম সরকার বাড়ির কিশোররা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ৫৩ রাউন্ড রাবার বুলেট, পাঁচ রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
স্থানীয় গার্লস হাইস্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলাকালে ছাত্রীর স্কুল ব্যাগ টেনে ধরার ঘটনা নিয়ে এই সংঘর্ষের শুরু। সংঘর্ষে ইটপাটকেলের আঘাতে পুলিশসহ ১৫ জন আহত হয়। এ সময় রাস্তার পাশে থাকা ২০টিরও বেশি দোকান ও বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হয়।
এই সব সংঘর্ষ নিয়ে জানতে চাইলে ভৈরব চেম্বারের সভাপতি আলহাজ হুমায়ূন কবির বলেন, ভৈরব একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্য ও নদীবন্দর। কিশোরগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের প্রবেশমুখ হিসেবে এখানে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে লোকজন নানা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছে। কিন্তু ইদানীং উঠতি বয়সী কিশোরদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর হামলায় আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েই নিরীহ ব্যবসায়ীদের দোকানপাটে হামলা করছে। ভাঙচুরসহ লুটপাট করছে। এতে ব্যবসায়ীরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
হুমায়ূন কবির আরও বলেন, আমরা এইগুলো বন্ধে চেম্বারের পক্ষে বহুবার উদ্যোগ নিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়েছি। কিন্তু অভিভাবকদের অসযোগিতা আর অসচেতনতার কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না। এইসব হামলা ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
কিশোর গ্যাংদের বিষয়ে জানতে চাইলে ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাকছুদুল আলম জানান, সামান্য ঘটনা নিয়ে ওরা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। অনেক সময় অনেকে জানেই না, কি নিয়ে তারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। পুলিশ প্রতিটি ঘটনায় উপস্থিত হয়ে সামাল দিয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়াও চালিয়েছে। কিন্তু এইসব ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সমাজপতিরা যদি এগিয়ে না আসেন, তবে কিছুতেই বন্ধ হবে না। তাদের সন্তানরা ঠিকমত স্কুলে যায় কি না এবং কাদের সাথে চলে, বিনা কাজে রাতে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে কি না, এইসব বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে।
ভৈরবে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়ে গেছে স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে পুলিশের সহায়তায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের একটি তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকায় থাকা কিশোরদের অভিভাবকদের ডেকে এনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এইসব কিশোররা সংঘর্ষে লিপ্ত হলে তাদের সাথে সাথে অভিভাবকদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।