মেঘনায় ধরা পড়ছে ইলিশ, পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ
দীর্ঘদিন পর ভোলার মেঘনা ও সাগরে ইলিশ ধরা পড়ায় হাসি ফুটতে শুরু করেছে জেলেদের মুখে। তবে সেই হাসি ম্লান হতে চলেছে পুলিশের ও রাজনৈতিক পরিচয়ে চাঁদাবাজিতে। এমন অভিযোগ সাধারণ জেলেসহ আড়তদারদের। মাছ নেওয়াসহ জেলেদের জিম্মি করে আদায় করা হয় চাঁদা।
এর প্রতিকার চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার (১২ সেপ্টম্বর) জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন আড়তদার ও বাংলাদেশ উপকুলীয় মৎস্য ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।
দ্বীপ জেলা ভোলার চারপাশটাই মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী বেষ্টিত। এখানে কয়েক লাখ জেলে রয়েছে, যারা মেঘনা ও সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। ইলিশের মৌসুম অনেক আগেই শুরু হলেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা পাচ্ছিল না জেলেরা। মৌসুমের শেষে এসে কিছুটা হলেও ইলিশের দেখা পাচ্ছে তারা। তাই ব্যস্ত মেঘনা পাড়ের মাছঘাটগুলো। জেলার সর্বদক্ষিণে চরফ্যাশন উপজেলার সামরাজ মাছঘাট। এর আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি মাছঘাট রয়েছে। ফজরের পর থেকেই এসব ঘাটে ইলিশ বিক্রির হাক-ডাক শুরু হয়। দুপুর ১২টার পর থেকেই কমে আসে ইলিশ বিক্রি। তখন চলে প্যাকেজিংয়ের কাজ। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝড় আর উত্তাল মেঘনার সঙ্গে যুদ্ধ করে ইলিশ ধরার পর যখন তা চিলের মত ছোঁ মেরে নিয়ে যায় এবং জিম্মি করে আদায় করা হয় চাঁদা তখন জেলেদের আর কষ্টের সীমা থাকে না। আড়তদাররা থাকেন আতঙ্কিত কখন যেন ফোনে আসে বিকাশে অথবা নগদে টাকা পাঠান, না হলে জেলে, নৌকা, জাল কিছুই ছাড়া হবে না।
চরফ্যাশন সামরাজ মাছঘাটের আড়তদার মিলন মাস্টার বলেন, ‘নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানার নিঝুম দ্বীপ (বন্দরটিলা) নৌপুলিশ মাছ ধরার ট্রলারসহ নাছির মাঝি ও তাঁর জেলেদের আটক করে চাঁদা দাবি করে। কথা বলতে চাইলে বলেন, কথা বলা যাবে না। বলে মোবাইল বন্ধ করে দেন। পুনরায় চেষ্টার পর ফোনে পাইলে বলেন, বিকাশে টাকা পাঠান। পরে ১৪ হাজার টাকা দেই।’
আড়তদার আব্দুর করিম বলেন, পুলিশ জালসহ নৌকা ধরেই বিকাশে চার হাজার টাকা চায়। আমি দুই হাজার টাকা দেই।’
আড়তদার মো. আলাউদ্দিন গাজী বলেন, ‘ট্রলারের মাঝি ফোন দিয়ে বলে, ভাই টাকা পাঠান কোস্ট গার্ড ধরছে। তখন ১৭ হাজার টাকা দেওয়ার পরও রক্ষা পায়নি। চর পিয়ালে মাঝিসহ জেলেদের ফেলে চলে যায়। অপর একটি ট্রলার তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে।’
কাশাল মাঝি বলেন, লাখ লাখ টাকা প্রতিদিন চাঁদাবাজি করছে পুলিশ। তাদের প্রতিরোধ করার কোনো উপায় পাচ্ছি না। অপরদিকে নৌপুলিশের কথা বলে চরফ্যাশন ঢালচরে রাজনৈতিক পরিচয়ে নদীতে ট্রলার থেকে চাঁদা নেয়। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে জানালে তারা দ্রুত চর কুকরী-মুকরীর নৌপুলিশকে জানায়। এরপর ১২ আগস্ট সকালে সেই টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয় চাঁদাবাজরা।’
এমন বহু অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে অভিযোগের শীর্ষে রয়েছে নিঝুমদ্বীপের নৌপুলিশ আর দ্বিতীয় অবস্থানে মনপুরা থানা পুলিশ।
এমন পুলিশি চাঁদাবাজিতে আতঙ্কিত সাধারণ জেলেদের পাশাপাশি আড়তদাররাও। বিকাশ কিংবা নগদে টাকা পাঠিয়ে ছাড়িয়ে আনা হচ্ছে প্রতিদিন জেলেদের। নৌকা থেকে ইলিশ নেওয়ার পাশাপাশি জেলেদের জিম্মি করা হয়। এরপর আদায় করা হয় চাঁদা। এর প্রতিকার চান আড়তদাররা।
বাংলাদেশ উপকূলীয় মৎস্য ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়ন চরফ্যাশন শাখার সভাপতি এবং আড়তমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন পাটাওয়ারী বলেন, ‘আমরা ডাকাত নয় পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। বেপারোয়া চাঁদাবাজি করছে পুলিশ। পুলিশকে জানালে কোনো লাভ নয়, উল্টো ক্ষতি হয়। এসব বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন কোস্টগার্ড সদস্যরাও। আমরা এর প্রতিকার চাই। স্বাধীনভাবে নিরাপদে মেঘনায় মাছ ধরতে চাই। প্রতিকার চেয়ে আমরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তিনি আমাদের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমাদের সামনেই মনপুরা থানার ওসির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথাও বলেছেন।’
নৌপুলিশের বিরুদ্ধে জেলেরা অভিযোগ দিচ্ছে স্বীকার করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, ‘এ সব বিষয় আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় তুলে ধরা হচ্ছে। এসব বিষয় আমাদের নয়, পুলিশের বিষয় তারাই ব্যবস্থা নিবেন।’
ভোলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ইলিশ মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের উৎপাত আসে। এগুলো আমরা সমাধান করার চেষ্টা করি। একই সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।’