ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ, স্যালাইনের জন্য হাহাকার
ফরিদপুরে স্বাস্থ্য বিভাগের চরম উদাসীনতায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একদিকে চরম অব্যবস্থাপনা অন্যদিকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যুর হার।
কোনোভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল। হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংকট। অনেক রোগীকে মেঝেতে-বারান্দায়, রাস্তায় বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে চরম সংকট দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় শিরায় দেওয়া অপরিহার্য (আইভি) স্যালাইনের। এ ছাড়াও কয়েকগুণ বেড়েছে রক্তের চাহিদা।
গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু দেখা দিলেও কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি ফরিদপুরে। তবে এবার গত দুই মাসের ভেতরেই ৩১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুরে। এর ভেতর রেকর্ড আক্রান্ত হয়েছে গত রোববার। সেদিন আক্রান্ত হয়েছে ৩০১ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালের পাশাপাশি স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে ওষুধের দোকানগুলোতেও। বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে রোগীর স্বজনদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। অধিকাংশ ফার্মেসিতে মিলছে না কোনো স্যালাইন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে একটা দুটা মিললেও গোপনে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। আবার স্যালাইন না পেয়ে অনেকেই ফিরছেন খালি হাতে।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, ফরিদপুরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলেও এ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো মাথা ব্যথা নেই। জেলার সিভিল সার্জনকে এ বিষয়ে কোনো বড় পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সচেতনতায় শুধু লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে, তাও সামান্য পরিসরে। এখন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগের রুটিন কাজের বাইরে কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
যদিও বিষয়টি অস্বীকার করে সিভিল সার্জন ডা. ছিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, স্যালাইনের সংকট হলে যেখানে স্যালাইন আছে সেখান থেকে এনে আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি। আশা করছি আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বেশি স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় সাধারণত দশমিক ৯ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড স্যালাইন রোগীর শরীরে পুশ করতে হয়। এটাকে ‘নরমাল স্যালাইন’ বলা হয়।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৫০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৭৮২ জন। জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৭১৪ জন। এর মধ্যে সাত হাজার ৯০১ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩১ জন রোগী।
ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডায়াবেটিস হাসপাতাল, মুজিব সড়কসহ বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালের সামনে অন্তত বিশটি ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শিরায় দেওয়া স্যালাইন পাওয়া যায়নি। দোকানদারেরা জানিয়েছেন, গত প্রায় মাস খানেক ধরে ওই স্যালাইনের প্রচুর চাহিদা দেখা দিয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় একেবারেই সরবরাহ নেই। তাই রোগীদের ফেরৎ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। যাও সরবরাহ পাওয়া যায়, তা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য।
বোয়ালমারী উপজেলা সদরে অবস্থিত ভাবনা ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে আসা মো. আসলাম শেখ বলেন, জেলা শহরের হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর ব্যাপক চাপ। হাসপাতালে শয্যা সংকট। স্যালাইন সংকট। বাজারের প্রায় দশটি দোকান খোঁজ করেও এক ব্যাগ স্যালাইন পাইনি। যে দোকানেই যাই সেখানে স্যালাইন নেই।
ফরিদপুর মেডিকেল হাসপাতাল এলাকায় ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে আসা নজরুল ইসলাম বলেন, আমার চাচা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালে স্যালাইন নেই। বাইরে থেকে কিনতেও পারছি না। অন্তত ১৫টি ফার্মেসি ঘুরে এক ব্যাগ স্যালাইন পেয়েছি। এরপরও যদি স্যালাইন দরকার হয়, তাহলে কোথায় পাব ভাবছি।
এ ব্যাপারে ফরিদপুরের কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি মাজহারুল আলম চঞ্চল বলেন, শুধু ফরিদপুর নয়, সারা দেশেই ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। ফরিদপুরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। গত প্রায় মাস খানেক ধরে স্যালাইনের সংকট চরম আকার ধারণ করছে। কোম্পানিগুলো স্যালাইন দিতে পারছে না। এখানে কোন সিন্ডিকেট নেই। কোনো ওষুধ ব্যবসায়ী নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম নিচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের সদস্য ও গরীবের বন্ধু হিসেবে পরিচিত সুমন রাফি বলেন, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভরা। ডেঙ্গু রোগীর জন্য স্যালাইন সংকট ও রক্তের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগী ও স্বজনদের মধ্যে হাহাকার চলছে।
এ ব্যাপারে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী পাংশা ড্রাগ এন্ড সার্জিক্যালের মালিক আকবর বিশ্বাস রাজু বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গত প্রায় এক মাস ধরে স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য ১০০০ এমএল স্যালাইনের দাম মাত্র ৮৭ টাকা। এমন পরিস্থিতি টাকায়ও মিলছে না স্যালাইন। কোম্পানির লোকজন চাহিদা মতো ডেঙ্গু রোগীর জন্য স্যালাইন দিতে পারছে না।
এ বিষয়ে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সোহেল শেখ বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জন্য ডিএনএস স্যালাইনের দাম নিয়ন্ত্রণে ফার্মেসিসমূহে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। গত দুই দিন আগে দাম বেশি নেওয়ায় কয়েক ফার্মেসি মালিককে জরিমানা করা হয়েছে। ফার্মেসি মালিকরা স্যালাইনের সরবরাহ ও সংকটের কথা জানিয়েছেন। তবে অভিযান পরিচালনা করা হলেও স্যালাইনের দাম বেশি নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে প্রতিনিয়ত চলছে হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন।