‘তখন আমার আবেগ কাজ করছে, বিবেক কাজ করে নাই’
চট্টগ্রামে দীর্ঘ ২৭ বছর পর পরিবারে ফিরে ছেলের হাতে খুন হন বাবা মো. হাসান। তাঁর খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা সাগরতীরে পাথরের ভেতর ফেলায় স্বামীকে ভালোবাসার আবেগে সহযোগিতা করেন ছোট ছেলের স্ত্রী আনার কলি। শ্বশুরের বিচ্ছিন্ন মাথাটি নিজের ব্যাগে বহন করে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে ফেলে দিয়ে আসেন আনার কলি। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকার একটি বাসায়।
আনার কলিকে মহেষখালী থেকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর স্বীকারোক্তিতে নগরীর পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়েও হাসানের মাথা উদ্ধার ও ছোট ছেলেকে ধরতে পারেনি পুলিশ। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় পাথরের ভেতর নানা কায়দায় দুদিন ধরে নিহত মো. হাসানের মাথা খুঁজছে পুলিশ।
আনার কলিকে গ্রেপ্তারের পর তিনি পিবিআইকে জানান, গত ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁর স্বামী ব্যাগে ভরে বাবা হাসানের বিচ্ছিন্ন মাথাটি সমুদ্র সৈকতে পাথরের নিচে ফেলে দেন। এ হত্যাকাণ্ড তাঁর দুই ছেলে ও স্ত্রীর পরিকল্পনায় হয়েছে বলেও তিনি সাংবাদিকদের জানান।
আনার কলি সাংবাদিকদের জানান, স্বামীকে এসব অপরাধমূলক কাজে সহযোগিতা করাটা তাঁর বড় অপরাধ। তাঁর দাবি, এ সময় স্বামীর প্রতি ভালোবাসার টানে তাঁর আবেগ কাজ করেছে, বিবেক কাজ করেনি।
আনার কলি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তখন আমার আবেগ কাজ করছে, বিবেক কাজ করে নাই। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আদালত হচ্ছে মানুষের বিবেক। তখন যদি আমার বিবেকটায় কাজ করতো তাহলে আমি এত বড় পাপের মধ্যে জড়িয়ে যেতাম না। কারো কথা না ভাবলেও একবার আমার সন্তানের কথা ভাবতাম।’
হাসানের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানের স্বীকারোক্তির বরাতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কর্মকর্তারা জানান, ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর ও তাঁর স্ত্রী আনার কলি তাদের বাবা হাসানের মাথার অংশটি সাগরে ফেলেছেন। এরপর তাদের ধরতে অভিযান চালায় পিবিআই। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে পাওয়া তাঁর (হাসান) দেহের টুকরো অংশগুলো মেলানোর পর তাঁর পরিচয় শনাক্ত করে পিবিআই।
হাসান আলী দুই ছেলের হাতে খুন হন। সহযোগী হিসেবে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও এক পুত্রবধূ। হত্যার আলামত গায়েব করতে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানেরা ১০ টুকরো করেছিলেন হাসান আলীর দেহ। পরে নগরীর তিনটি স্থানে ফেলে দিয়ে আসা হয় তাঁর দেহাংশ। শ্বশুরের মাথাটি নিজের ব্যাগে বহন করে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ফেলে দিয়ে আসেন আনার কলি।
আনার কলিকে গ্রেপ্তারের পর ঘটনার সব কিছু পরিষ্কার হয়েছে বলেও জানান পিবিআই কর্মকর্তারা। তাঁর স্বামী জাহাঙ্গীরকেও ধরতে পিবিআইয়ের দুটি টিম কাজ করছে।
সহকারী পুলিশ সুপার (পিবিআই) মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘এ ঘটনায় নিহত হাসানের স্ত্রী সানোয়ারা বেগম ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর পারিবারিক কলহের জের ধরে নগরীর ইপিজেড এলাকার একটি বাসায় হত্যা করা হয় হাসানকে। পরে তাঁর মরদেহ নয় টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ২৭ বছর পর পরিবারের কাছে ফিরে আসেন হাসান। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর।’
যে কারণে এই হত্যাকাণ্ড
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকার পর বাড়ি ফিরে এসেছিলেন বাঁশখালীর বরইতলীর বাসিন্দা হাসান আলী। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক হাসান আলী ২৬ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে সিলেটে চলে যান।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাড়িতে ফিরে আসার পর তাঁর বাবা হাসান আলী ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা চালান। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। এমন ক্ষোভ থেকেই বাবাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। হত্যার সময় মোস্তাফিজ নিজে ও তাঁর ছোট ভাই শফিকুর রহমান বাবার গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরেন। বাসায় তখন মা, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ছিলেন। সেদিন বাবার লাশটি বস্তায় ভরে বাসার খাটের নিচে রেখে দেন তাঁরা। পরে টুকরা করে বস্তা ও লাগেজে ভরে দূরে ফেলে দেন। লাগেজটি ফেলেন পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাটে আর বস্তাটি বাসার পাশে একটি ডোবায় ফেলে দেন। তাঁর ছোট ছেলে শফিকুর ও তাঁর স্ত্রী আনার কলি মাথাটি পতেঙ্গা সৈকতে ফেলে দিয়ে আসেন।