কে এই পি কে হালদার
পুরো নাম প্রশান্ত কুমার হালদার। আলোচিত এই ব্যক্তি অধিক পরিচিত পি কে হালদার নামে। ছিলেন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। করেছেন অর্থ লোপাট। সেটিও সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। দুদকের মামলার পর পরিচিত হয়ে ওঠেন দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপিদের একজন হিসেবে। বেরিয়ে আসতে থাকে থলের আরও সব বিড়াল। অবশেষে আদালতে হয়েছেন দোষী সাব্যস্ত।
জন্ম ও ছাত্রজীবন
পি কে হালদারের জন্ম পিরোজপুরে। এই জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে জন্ম নেওয়া পি কে হালদারের মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছাত্রজীবনে ছিলেন মেধাবি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তিনি ও তার ভাই স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে দুজনই ব্যবসায় প্রশাসনের আইবিএ থেকে এমবিএ করেন। পাশাপাশি চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট (সিএফএ) সম্পন্ন করেন পি কে হালদার।
কর্মজীবন
আইআইডিএফসিতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন প্রশান্ত কুমার। এরপরের বছর হঠাৎই হয়ে ওঠেন অর্থনৈতিক খাতে বড়কর্তা। মাত্র ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়ে হয়ে যান রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি। তখন থেকে চাপা কানাঘুষা শুরু হয়। অনেকের বলতে শুরু করেন ‘অদৃশ্য আশীর্বাদ’র কথা। এরপর ২০১৫ সালে বনে যান এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি।
দুই ভাই মিলে নিজেদের কোম্পানি
পি কে হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহার পরিচালনায় ২০১৪ সালে কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয়। এ বছরই কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে।
২০১৮ সালে পি কে হালদার তার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদারকে নিয়ে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে খোলেন কোম্পানি। যার কার্যালয় ছিল কলকাতার মহাজাতি সদনে। এর অন্যতম পরিচালক ছিলেন প্রীতিশ।
এ ছাড়া নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন বলে জানা যায়।
অবশেষে মামলা
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদকের উপপরিচালক সালাউদ্দিন। সেই মামলার তদন্তে নেমে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের তথ্য পায় মামলার তদন্ত সংস্থা। তবে, মামলা হওয়ার আগেই পি কে হালদার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তদন্ত করে পি কে হালদারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
পি কে’র সঙ্গী যারা
দুদকের করা মামলাটিতে পি কে হালদারসহ বাকি আসামিরা হলেন—পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, পূর্ণিমা রানি হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রীতিশ কুমার হালদার, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গমোহন রায়, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারী, সুকুমার মৃধা ও অনিন্দিতা মৃধা। এদের মধ্যে অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারী, সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা কারাগারে আটক রয়েছেন।
অর্থ লোপাটকাণ্ড
মামলার নথি বলছে, পি কে হালদার নামে-বেনামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয় হাজার ৭৯০ শতাংশ জমি কিনেছেন। এ সম্পদের বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। বর্তমানে এর বাজারমূল্য ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিজের নামে জমি কিনেছেন চার হাজার ১৭৪ শতাংশ। এর দাম দলিলে দেখানো হয়েছে ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা। অথচ, এ সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য ২২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পি কে হালদারের নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
পি কে হালদার তার নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানি হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন নির্মাণ করেছেন, যেটির মূল্য ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। নিজের কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে দুই একর জমির ওপর নির্মাণ করেন আট তলা হোটেল, যার আর্থিক মূল্য এখন ২৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া পি কে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গমোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি। এর বর্তমানে দাম রয়েছে ১৬৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও কানাডিয়ান ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যের বরাত দিয়ে দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভাই প্রীতিশ হালদারের কাছে এক কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডীয় ডলার পাচার করেন পি কে হালদার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮০ কোটি টাকারও বেশি।
অবশেষে দোষী সাবস্ত করে আদালতের রায়
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন পি কে হালদার। আজ রোববার (৮ অক্টোবর) তার বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণা করেছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০-এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। রায়ে তাকে দিয়েছেন ২২ বছরের কারাদণ্ড।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহম্মেদ সালাম গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বাকি ১৩ জনকে পৃথক দুই ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
পি কে এখন কোথায়
২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে যখন তাঁর দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠঅনগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিয়ে ব্যর্থ হতে শুরু করে, তখন পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে যান। পরে বসবাস শুরু করেন কানাডা ও সিঙ্গাপুরে। এরপর আবার চলে আসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ২০২২ সালের ১৪ মে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরে অভিযান চালিয়ে সুকুমার মৃধা নামের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির বাড়ি থেকে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। সেখানে তিনি নাম পাল্টে শিবশংকর হালদার পরিচয়ে থাকতেন।