মনোনয়ন পাইয়ে দিতে ৩০০ কোটি টাকা দাবি করতেন তুষার : র্যাব
আবু হানিফ ওরফে তুষার। তিনি রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিতেন। ওই পরিচয়ে মানুষের সঙ্গে মিশতেন। শুধু তাই নয়, তুষার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়ের পরিচয়ও দিতেন। এসব পরিচয় দিয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করতেন তুষার।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন এনে দেওয়ার কথা বলে তিনি মোটা অংকের ঘুষ দাবি করেছেন অন্তত ১২ জনের কাছে। এ ১২ জনের একজন তিনি, যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সহকারীর পরিচয় দিতেন!
র্যাবর দাবি, তুষার যার পিএস পরিচয় দিতেন, তার কাছে ৩০০ কোটি টাকা চেয়েছেন নৌকার মনোনয়ন এনে দেবেন বলে! তিনি এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ ছাড়া অন্যান্য মনোননয়প্রত্যাশীদের কাছেও ৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা করে চেয়েছেন মনোনয়ন এনে দিবেন বলে। তার মুঠোফোন ঘেঁটে এমন অন্তত ১২ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের তিনি মনোনয়ন এনে দিতে চেয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১-এর অভিযানে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়া (৩৯) নামের এ প্রতারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তাদেরকে টার্গেট করত একটি চক্র। পরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ৫০ থেকে থেকে ৩০০ কোটি টাকা দাবি করতেন। দামি গাড়িতে করে বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে বসে হতো চুক্তি। ইতোমধ্যে মনোনয়ন পেতে ১০ থেকে ১২ জনের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন বা পদোন্নতির আশ্বাস দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের পদ দেওয়ার প্রলোভন বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। তিনি এ পর্যন্ত ৩০ জনকে সরকারি চাকরি দিয়েছেন। অথচ, তার কাছে শতশত মানুষ চাকরির জন্য টাকা দিয়েছেন।
র্যাব বলছে, অভিযানে তুষারের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, অ্যামুনেশন, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি ও বিভিন্ন ভিডিও এবং এডিট করা ছবি উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায়। এই এলাকা থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন এই প্রতারক।
খন্দকার আল মঈন বলেন, তুষার প্রতারণা করার জন্য বিভিন্ন সময় নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতেন। মোবাইলফোনে বিদেশি বিভিন্ন নম্বর প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্যদের নামে সেইভ করতেন। এরপর বিশ্বাস অর্জনের জন্য পরিবারের সদস্য সেজে পদায়ন ও পদোন্নতি, সরকারি চাকরি দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রতারণার নামে টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছিল। এমনকি প্রতারণার বিষয়টি আরও নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ছবির সঙ্গে নিজের ছবি এডিট করে বসাতেন। নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নিকটাত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মিথ্যা দাবি করতেন। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অংশ নিয়ে কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তার টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের পাঠাতেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, আবু হানিফ এইচএসসি পাস হলেও তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে বলে মিথ্যা পরিচয় দিতেন। ২০০৮ সালে মোটরপার্টসের ব্যবসার করত। পরিবহণ সেক্টরে দেশের বিভিন্ন রুটে তুষার এন্টারপ্রাইজ পরিবহন নামে তার বেশ কয়েকটি বাস ও নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রাইভেটকার রয়েছে। সে ঢাকার নাখালপাড়া ও ধানমণ্ডি এলাকায় দলীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে বলে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা চালাতো।
কমান্ডার মঈন বমেন, ২০১৪ সালের পর থেকে একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করত। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌশলে রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পরিচিত হয়। পরে সুসম্পর্ক তৈরি করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অফিস বা কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি তুলে এবং প্রতারণার কাজে এই ছবিগুলো ব্যবহার করতেন। ২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে। বিভিন্ন সময়ে সে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে অনুষ্ঠান, সেমিনারে অংশগ্রহণ এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন সময় ভ্রমণ করে ছবি তুলে তা ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করে।
র্যাব বলছে, এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্পন্সর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসা, প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জমি ও সম্পত্তির মালিক হওয়া, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় একাধিকবার কারাভোগও করেছে এই প্রতারক।