নির্বাচনি তফসিল পেছাতে ইসিকে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির খোলা চিঠি
দেশে এখন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আজ শনিবার (৪ নভেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে সাইফুল হক এ সব তথ্য জানান। একইসঙ্গে তিনি ইসিকে সাতটি পরামর্শ দিয়ে খোলো চিঠি দিয়েছেন।
আজ নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় সভায় নিমন্ত্রণ থাকলেও যোগ দেয়নি দলটি। পরে সেগুনবাগিচায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সংহতি মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলন করে তারা। সেখানে না যাওয়ার কারণ জানিয়ে পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো খোলা চিঠি প্রকাশ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, আকবর খান, আনছার আলী দুলাল, মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাক, ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, জোনায়েদ হোসেন প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে সাইফুল হক ইসিকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দিয়ে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়ে পরিষ্কার নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। তিনি বলেন, ‘সরকার ও সরকারি দল যদি জবরদস্তি করে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করতে চায়, তাহলে বাস্তব পরিস্থিতি ও বিবেকের দায় নিয়ে কমিশনের সদস্যরা দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। দেশ ও দেশের মানুষ কোনোভাবেই আর একটি ব্যর্থ, অকার্যকর ও একতরফা তামাশার নির্বাচনের দায় নিতে পারবে না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি পার্টির খোলা চিঠি হুবহু তুলে ধরা হলো
জনাব,
আমাদের সালাম নেবেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে আজ ৪ অক্টোবর, ২০২৩ বিকেল ৩ টায় আমাদেরকে নির্বাচন কমিশন আহুত আলোচনা সভায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা এই আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করছি না। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের মতামত ও প্রস্তাব নিম্নরূপ
১। আপনারা আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির অগ্রগতিসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য আজ যে সভার আয়োজন করেছেন তা বিশেষ কোনো ফল বয়ে আনবে বলে আমরা মনে করতে পারছি না। আমাদের মনে হয়েছে, এটা নিছক আনুষ্ঠানিকতা ও আপনাদের দিক থেকে এক ধরনের ব্রিফিং।
২। গত বছর আমরা আপনাদের আহুত সংলাপে অংশ নিয়েছিলাম। সংলাপে আমাদের দিক থেকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনেকগুলো মতামত ও পরামর্শ দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেসব আপনারা আমলে নিয়েছেন বলে কোনো তথ্য নেই।
৩। গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি, কয়েকদিন পর নভেম্বরের মাঝামাঝি আপনারা জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু, দেশের প্রবল সংঘাতময় ও অস্থিতিশীল সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য মোটেও অনুকূলে নয়। নির্বাচন কমিশনেরও কেউ কেউ এই ধরনের বক্তব্যই দিয়েছেন। তারা বাস্তব পরিস্থিতিকেই তুলে ধরেছেন, সন্দেহ নেই। আর আপনারা নিশ্চয়ই ভালভাবে অবহিত আছেন যে, দেশের প্রায় সব বিরোধী দল বর্তমান কর্তৃত্ববাদী ও দমনমূলক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংগ্রহণ করবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। আর আপনাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশনকেও সব বিরোধী দল ও ভোটারেরা পুরোপুরি পক্ষপাতদুষ্ট বলেই মনে করে।
৪। আমরা সুস্পষ্টভাবে মনে করি, সরকার প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধাত্বক অবস্থান থেকে বিএনপিসহ তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করছে, তা কোনোভাবেই একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের সহায়ক নয়। এ রকম অবস্থায় একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে চরম দায়িত্বহীন পদক্ষেপ। নির্বাচন কমিশনের এরকম তৎপরতা হবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো সরকার ও সরকারি দলের আর একটি নীলনকশার, আর একটি সাজানো নির্বাচনি তামাশামাত্র। বিদ্যমান অবস্থায় তফসিল ঘোষণার অর্থ হবে বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রেখে সরকার ও সরকারি দলের নির্বাচনি নীল নকশা বাস্তবায়নের সহযোগী হওয়া।
৫। গত দুটি প্রহসনমূলক জাতীয় নির্বাচনের পর বাস্তবে গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনি ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। এই পরিস্থিতি উত্তরণে এই পর্যন্ত আপনাদের দিক থেকে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আর আপনারা অবহিত আছেন যে, বিরোধী দলগুলো আপনাদেরকে সরকার ও সরকারি দলের ইচ্ছাপূরণের সহযোগী হিসাবে বিবেচনা করে আগামীতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আপনাদের পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন তফসিল ঘোষণা হবে ভোটের অধিকার বঞ্চিত দেশের জনগণ ও বিরোধী দলসমূহের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা।
৬। আমরা জানি যে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা আপনাদের দায়িত্ব। কিন্তু, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরোধী দলগুলো ও জনগণকে আস্থায় না নিয়ে একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা দেশের নির্বাচনকেন্দ্রীক সংকট আরও ঘনীভূত করবে এবং দেশকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে। এই ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরির দায়দায়িত্ব আপনাদের ওপরও বর্তাবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বাস্তবে দলনিরপেক্ষ সরকার ব্যতিরেকে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো অবকাশ নেই।
৭। আপনারা একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সরকারের অংগ সংগঠন নন। দেশের প্রবল বৈরী ও সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতিতে আপনারা এই অবস্থান সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দিতে পারেন যে, দেশে এখন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। এই কারণে তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দিয়ে নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আপনারা প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়ে বাস্তব ও নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। সরকার ও সরকারি দল যদি তারপরও জবরদস্তি করে আপনাদের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে নানাভাবে বাধ্য করতে চায়, সেক্ষেত্রে নৈতিক ও বিবেকের দায় নিয়ে কমিশনের দায়িত্ব থেকে আপনারা সরে দাঁড়াতে পারেন। কারণ, দেশ ও দেশের মানুষ কোনোভাবেই আর একটি ব্যর্থ, অকার্যকর ও তামাশার নির্বাচনের দায় নিতে পারবে না। আমরা আশা করি, আমাদের মতামত ও প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রীক সংকট উত্তরণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপনারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।