ক্ষমতাই যার পুঁজি, কাটান বিলাসী জীবন!
অনেক আগেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে গুলশান থানা ছাত্রলীগ কমিটির। যদিও সেই কমিটিতেই চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। এই সুযোগেই নাকি ফুলে-ফেঁপে একাকার সভাপতি মোস্তাফা হোসেন হেলাল। করেন বিলাসী জীবন-যাপন। ঘোরেন দেশ-বিদেশে। অবস্থান নেন রাজকীয় হোটেলে। অভিযোগ বলছে, বিবাহিত হয়েও বহাল তবিয়তে পদ ধরে রেখেছেন তিনি।
এদিকে, বয়স হিসেবে ছাত্রলীগে থাকার যোগ্যতা হারালেও বহাল তবিয়তেই আছেন পদে। পদকে কাজে লাগিয়ে নাকি চলে তার চাঁদাবাজিও। যদিও এই প্রতিবেদকের কাছে সব বিষয়ে মুখ খোলেননি হেলাল। বিয়ে ও বয়সের বিষয়ে বলেছেন, ‘কমিটি দেওয়ার আগে বিয়ের বিষয়টি দেখা হয়, কমিটি হওয়ার পর এটি কোনো বিষয়ই না।’ আর বয়সের জবাবে বলেছেন, পদের কমিটি দেওয়ার সময় তোর বয়স ঠিক ছিল তার।
১৯৮৯ সালের ২ মার্চ পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া জন্মগ্রহণ করেন হেলাল। সে অনুযায়ী তার বর্তমান ৩৪ বছরের বেশি। অন্যদিকে, হেলাল সরকারি তিতুমীর কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০০৬-০৭ সেশনে স্নাতক এবং ২০১০-১১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। অর্থাৎ, ২০১৯ সালে দায়িত্ব পাওয়ার সময়ই তার বয়স ৩০ বছর ছিল।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫(ক) ধারায় বলা আছে, ‘অনূর্ধ্ব ২৭ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক স্বীকৃত যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারেন।’ যদিও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বয়স আরও দুই বছর বাড়িয়ে দেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে হেলালের বিষয়ে কথা হয়। তাদের দাবি, গুলাশান থানা ছাত্রলীগের সভাপতি পদ পাওয়ার আগে হেলাল মধ্যবাড্ডা এলাকায় পোস্ট অফিস গলিতে সিডি ও মোবাইল লোডের দোকান চালাতেন। ওই এলাকায় এক নারীকে বিয়ে করেন তিনি।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫(গ) ধারা অনুযায়ী, বিবাহিত ব্যক্তি ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান পাবেন না। কিন্তু, বহাল তবিয়তে তিনি গুলশান থানা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে আছেন।
অভিযোগ বলছে, ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর গুলশান এলাকার বিভিন্ন স্প্যা সেন্টার থেকে মাসিক চাঁদা তুলতেন হেলাল। তার বিরুদ্ধে গত ১৭ জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ৪২ কোটি টাকার হিসাব বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে।
চাঁদা দেয় এমন কয়েকটি স্পা সেন্টারের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা মেলে। তারা নিজেদের বা প্রতিষ্ঠানের নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, ছাত্রলীগের সভাপতি হেলালকে প্রতি মাসে চাঁদা না দিলে সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবাই ভয়ে ভয়ে চাঁদা দেন। এ ছাড়া হেলাল ব্যবসায়ীদের টাকা তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে তদবির বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি করেন।
হেলালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবি ঘেটে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় তিনি ভারত, সিঙ্গাপুরসহ একাধিক দেশে ভ্রমণ করেছেন। এ ছাড়া দেশের ফাইভ স্টার মানের হোটেল এবং রেস্টুরেন্টেও তার ছবি রয়েছে। এসব ভ্রমণ ও বিলাসী জীবন নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। টাকার উৎস নিয়ে উঠেছে প্রশ্নও।
গুলশান ১ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘‘মার্কেটে হেলালের কোনো দোকান নেই। এমনিতেই আগে এখানে আসতেন। একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। তবে, সভাপতি হওয়ার পর আর আসেন না।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এখন তিনি (হেলাল) তো টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তার আয়ের উৎস স্পা ব্যবসা আর অন্যের টাকা তুলে দেওয়ার নামে চাঁদাবাজি করা।’
গুলশান থানার ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমার কমিটির মেয়াদ আড়াই বছর হয়ে গেছে, এই অভিযোগে কমিটি ভেঙে দেন হেলাল। তার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব ছিল স্পা ব্যবসা বন্ধ করা নিয়ে। বছরখানেক আগে মানারাত স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে একটি স্পা বন্ধ করার জন্য ৯৯৯-এ ফোন করি। পুলিশ আসে। এসব নিয়ে মূলত তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু। তারপর ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত করে দেয়। ব্যক্তিস্বার্থে তিনি এসব করে যাচ্ছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার সভাপতি মোস্তফা হোসেন হেলাল বলেন, ‘আপনাকে যারা এসব বলেছে তাদের বক্তব্য নেন। আমার কোনো বক্তব্য নেই।’ এ সময় তিনি কথিত এক সংবাদিকের নাম উল্লেখ করে তার ছোট ভাই হিসেবে পরিচয় দেন। হেলাল বলেন, ‘আপনি প্রয়োজনে তার (ছোট ভাই) সঙ্গে কথা বলেন।’
বয়স ও বিয়ের কথা জানতে চাইলে হেলাল বলেন, ‘কমিটি দেওয়ার সময় আমার বয়স ঠিক ছিল। তখন বিবাহিতও ছিলাম না। কমিটি দেওয়ার আগে বিয়ের বিষয়টি দেখা হয়। কমিটি হওয়ার পর এটি কোনো বিষয়ই না।’
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হেলালের বিরুদ্ধে একাধিক বিয়ে এবং সন্তান থাকার অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। একজন নারী এসে হেলালের বিরুদ্ধে তার স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ছবিসহ লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, তিনি হেলালের স্ত্রী। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। সত্যতা মিললেও আমি একা-তো ব্যবস্থা নিতে পারি না, আমার সাধারণ সম্পাদক তার পক্ষ নিয়ে আছেন। তার জন্যই কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না।’
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদের কাছে হেলালের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আপনার মাধ্যমে অভিযোগগুলো জানলাম। তার বিরুদ্ধে যদি কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘আমি বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত আছি এবং মহানগর উত্তরের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদকে বলেছি তার বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে।’