নওগাঁয় গুপ্ত হামলার নেপথ্যে কারা?
গত দুই মাসে নওগাঁয় অন্তত পাঁচটি ‘গুপ্ত হামলার’ ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন একজন। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে অন্তত চারজন। এসব হামলার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ ঘটনাই রাতে ও নির্জন রাস্তায় ঘটেছে। হামলাকারীরা হেলমেট অথবা মুখোশ পরে মোটরসাইকেলে এসে নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে গুরুতর জখম করছে। আক্রান্তরা সবাই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই ‘গুপ্ত হামলায়’ জড়িত কারা সে প্রশ্নের জবাব মিলছে না।
নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে রানীনগর উপজেলায়। রানীনগরে তিনটি, আত্রাই ও নওগাঁ সদর উপজেলায় একটি করে ঘটনা ঘটেছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এসব হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুটি মামলা হয়েছে। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত একটি ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসব ঘটনায় জেলার আত্রাই-রাণীনগর কেন্দ্রিক সর্বহারাদের একটি দলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে তাদের পেছনে কারা, তা পরিষ্কার নয়। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ঠিক এভাবেই আবির্ভাব ঘটেছিল ‘হাতুড়ি বাহিনীর’। এবারও সাধারণ নির্বাচনের আগে একই কায়দায় হামলা হচ্ছে। বিএনপির অভিযোগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন দমাতে ‘গুপ্ত হামলা’ করা হচ্ছে। স্থানীয়দের ধারণা, মুখোশধারীদের পেছনে শক্তিশালী কেউ রয়েছে, তাই শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হচ্ছে না।
নওগাঁ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব বায়েজিদ হোসেন পলাশ বলেন, ‘সবাই বুঝতে পারছে যে, সরকারের ইন্ধনেই এসব চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। এসব ঘটনায় পুলিশ কাউকে ধরছে না।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘কার কাছে মামলা করব? কার কাছে বিচার চাইবো? মামলা করতে যাওয়ারও নিরাপত্তা নেই। রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না। পুলিশ মামলা নিতে চায় না। একমাত্র আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে বিচার চাওয়ার জায়গা নেই।’
গত শনিবার রাত ১০টার দিকে নওগাঁ-সান্তাহার সড়কের ইয়াদ আলীর মোড় এলাকায় কামাল আহমেদকে পরিবহনকারী অটোরিকশার গতি রোধ করে হেলমেট ও মাস্ক পরে দুর্বৃত্তরা তাঁর ওপর হামলা করে পালিয়ে যান। এঘটনায় সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও হামলাকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
নিহত কামাল নওগাঁ পৌরসভার রজাকপুর মহল্লার মৃত মমতাজ আহমেদের ছেলে এবং ৯নং ওয়ার্ড বিএনপি’র আহবায়ক ও সাবেক সভাপতি। তিনি নওগাঁ জেলা ট্রাক পরিবহণ বন্দোবস্তকারী সমবায় সমিতি লিঃ এর সদস্য এবং নওগাঁ নজরুল একাডেমির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) নওগাঁ জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন।
এ বিষয়ে মামলার বাদী নিহতের একমাত্র ছেলে নবাব বলেন, 'আমার বাবার সাথে কারো কোনো ধরনের বিরোধ ছিল না। আমরা জানতে চাই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত আছে? আমার বাবার কি অপরাধ ছিল? আমার বাবাতো কারোর কোন ক্ষতি করেনি। আমি চাই সঠিক তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি হোক।’
এ বিষয়ে নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়সাল বিন আহসান বলেন, ‘হামলার সময় ঘটনাস্থলে রাস্তার পাশে থাকা একটি বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজে দেখা গেছে, হামলাকারীরা ছয়-সাতজন ছিলেন। তবে হেলমেট ও মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় কাউকে চিনতে পারা যাচ্ছে না। তবে প্রত্যক্ষদর্শী, পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে, ইতোমধ্যে এই হত্যার কিছু ক্লু পাওয়া গেছে। আশা করছি, খুব শিঘ্রই হত্যাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
এই ঘটনা ছাড়াও গত দুই মাসে নওগাঁর আত্রাই এবং রানীনগর উপজেলায় বিএনপির চার নেতাকে হেলমেট ও মুখোশ পরে দুর্বৃত্তরা একইভাবে কুপিয়ে জখম করে ফেলে যায়। কুপিয়ে রগ কেটে দেওয়া এবং হাত-পা কেটে ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
প্রথম ‘গুপ্ত হামলা’ হয় গত ২৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন রাত ৮টা নাগাদ মোটরসাইকেল যোগে আবাদপুকুর বাজার থেকে বাড়ী ফেরার পথে আবাদপুকুর-রাণীনগর সড়কের আমগ্রামের মোড় নামকস্থানে ১০/১৫জন মুখোশধারী যুবদল নেতা আনোয়ার হোসেন (৩২) কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। আনোয়ার উপজেলার আমগ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে এবং উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
জানতে চাইলে যুবদল নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মামলা করে আর কী হবে? মামলা করলে পুলিশ ব্যবস্থা তো নেবেই না, উল্টো হামলাকারীদের আক্রোশের শিকার হব। তখন জীবনটাই চলে যেতে পারে।’
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে আত্রাই উপজেলার জগদাস স্কুল থেকে মোটরসাইকেল যোগে বাড়ী ফেরার পথে পাঁচুপুর মোড় নামকস্থানে পৌছালে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আবুল হোসেন (৫২) নামে এক শিক্ষকের দুই পায়ের রগ কেটে দেয়। শিক্ষক আবুল হোসেন উপজেলার বিহারীপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং জামায়াত নেতা। আবুল হোসেন এখনো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুধুমাত্র এঘটনায় পুলিশ সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত ২৩ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ রাণীনগর উপজেলার বড়গাছা বাজার থেকে একই এলাকার মালশন গ্রামে মোটরসাইকেল যোগে ফেরার পথে বড়গাছা-মালশন সড়কে পথরোধ করে তিনটি মোটরসাইকেলে ৫/৬জন দুর্বৃত্ত আবু রায়হান (৪৫) কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এসময় তার বাম হাতের কবজি প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রায়হান বড়গাছা গ্রামের মুন্টু মিয়ার ছেলে এবং সে বড়গাছা ইউনিয়ন বিএনপি‘র সাধারণ সম্পাদক।
আবু রায়হান বলেন, দল করার কারণেই আমি আক্রোশের শিকার হয়েছি। মামলা করলে আরও হয়রানির শিকার হতে পারি। এ আশঙ্কায় মামলা করিনি।
গত ১২ নভেম্বর রাণীনগর উপজেলার পারইল ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান জাহিদকে সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ৬/৭জন হেলমেট ও মাস্ক পরিহিত দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এসময় তার ডান হাতের কবজি প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। জাহিদ পারইল গ্রামের তছির উদ্দীন ফকিরের ছেলে এবং পারইল ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি।
তবে এসব হামলার ঘটনায় কামাল আহমেদ এবং শিক্ষক আবুল হোসেনের পক্ষ থেকে থানায় দুটি মামলা ছাড়া আর কেউ মামলা বা থানায় অভিযোগ করতে সাহস করেনি।
জাহিদের স্ত্রী শ্যামলী আক্তার বলেন, জাহিদের পিঠ, কোমর এবং উরুতে প্রায় ৯টি স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুত্বর আঘাত করা হয়েছে। এছাড়া ডান হাতের কব্জি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে জাহিদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় আইসিইউতে মূমুর্ষ অবস্থায় রয়েছেন। চেয়ারম্যান সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এঘটনায় আর কিছু বলতে পারবেন না তিনি।
তিনি বলেন, পুলিশ নিজে বাদী হয়ে অনেক মামলা করে থাকে। এসব মামলা তারা নিজেরা বাদি হয়ে করতে পারে।
নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটি ঘটনা গুরুত্বের সাথে তদন্ত করছি। তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।’