‘বিএনপি করা কি অপরাধ, আমার স্বামীকে ফেরত চাই’
দাদার সঙ্গে এসেছে তার দুই শিশু নাতনি বর্ষা ও নূরী। কারাবন্দি মায়ের জন্য কান্না করে মুক্তি দাবি করে এই দুই শিশু। বাবা বিএনপিনেতা আব্দুল হামিদ ভূইয়াকে না পেয়ে মা পুতুলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। একইভাবে কারাবন্দি স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবুল কালামের ছয় বছরের ছেলে সিয়ামও মায়ের সঙ্গে এসেছে ওই প্রতিবাদ সমাবেশে। শিশু সিয়াম কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার বাবার মুক্তির দাবি জানায়।
আজ মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে আসেন বিএনপির কারা নির্যাতিত, খুন-গুমের শিকার নেতাকর্মীদের দুই শতাধিক স্বজনরা।
মানববন্ধনে পরিবারের সদস্যরা ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের হৃদয়বিদারক বর্ণনা তুলে ধরেন। বিএনপি আয়োজিত এই মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন কারাবন্দি বিএনপিনেতা মির্জা আব্বাসের সহধর্মিণী আফরোজা আব্বাস।
মানববন্ধন শেষে নির্যাতিত পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করলে প্রেসক্লাবে সামনে তাদেরকে বাধা দেয় পুলিশ। পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানের নেতৃত্বে নির্যাতিত পরিবারের চারজনকে যাওয়ার অনুমতি দেয় পুলিশ। এ সময় সেলিমা রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা আইনজীবীদের মাধ্যমে এই স্মারকলিপি পাঠিয়ে দেব।’
এদিকে মানববন্ধনে তিন ছেলের গ্রেপ্তারের বর্ণনা দিয়ে আব্দুল হাই বলেন, ‘আমার তিন সন্তানকে কারা অন্তরীণ করা হয়েছে। এক ছেলেকে ১০ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। বড় ছেলেকে না পেয়ে তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে পুত্রবধূকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে পুলিশ। অথচ, আমার ছেলের বউ রাজনীতিতে জড়িত নন।’
আব্দুল হাই বলেন, ‘বিএনপি করা কি আমাদের অপরাধ? আমরা শুধু সুষ্ঠু ভোটের অধিকার চেয়েছি।’
২০১৩ সালে গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা কাওসারের স্ত্রী মিনু আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামীকে যখন গুম করা হয় তখন আমার সন্তানের বয়স তিন। ১০ বছর ধরে সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।’
ঢাকা মহানগর বিএনপিনেতা লিয়ন হক ও রাজিব হাসানের বোন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, এক ভাইকে পুলিশ এক মাস গুম করে রাখার পর গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। আমার পরিবার সদস্যদের গ্রেপ্তার-গুম-খুন করে সরকার তছনছ করে দিয়েছে।’
লিয়ন হক ও রাজিব হাসানের বোন আরও বলেন, ‘এক বছর আগে আমার ভগ্নিপতিকে লক্ষ্মীপুরে র্যাব গুলি করে মেরে ফেলেছে, তিনি বিএনপি করতেন। যদি আমার ও আমার পরিবারের বাঁচার অধিকার না থাকে, তাহলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলুন, একজন একজন করে কষ্ট দিয়ে মারবেন না। আমরা বিএনপির রাজনীতি করে অপরাধ করেছি, আমরা পুরো পরিবার এখন মরতে চাই।’
ঢাকা মহানগর বিএনপিনেতা শেখ মনিরুজ্জামানের স্ত্রী অভিযোগ বলেন, ‘রাত ২টার দিকে দরজা ভেঙে আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’
ছাত্রদলের নেতা আমান উল্লাহ আমানের বড় ভাইয়ের মেয়ে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার চাচাকে না পেয়ে পুলিশ আমার বাবাকে নিয়ে নির্যাতন করেছে। রিমান্ডে নিয়েছে।’
জেলখানায় মারা যাওয়া বিএনপিনেতা আবুল বাসারের স্ত্রী বলেন, ‘আমি আমার স্বামী হারানোর বিচার চাই, আমার সন্তানকে এতিম করেছে, পুলিশ আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে। এর ফলে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী বলেন, ‘আমার কোথায় যাব! আমার স্বামীর মামলার বাদী পুলিশ, মামলা করল পুলিশ, সাক্ষী দিল পুলিশ, এটা কেমন বিচার!’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের স্ত্রী রহিমা শাহজাহান মায়া বলেন, ‘আমার স্বামীকে চার বছরের জন্য জেল দিয়েছে, তার কোনো দোষ নেই। আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হোক।’
কারাবন্দি বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর মেয়ে ব্যারিস্টার তাবাসসুম বলেন, ‘আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ, তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত। তাকে প্রতিমাসে কেমোথেরাপি দিতে হয়। অথচ তাকে মুক্তি না দিয়ে জেলে ভরে রেখেছেন, আমার বাবার মুক্তি চাই।’
গ্রেপ্তার যুবদলনেতা রানার মা বলেন, ‘আমার ছেলে নির্দোষ। আমি ছেলের মুক্তি চাই। আমার ছেলেকে মুক্তি দেন।’
সাংবাদিকনেতা কাদের গনি চৌধুরীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল হাই শিকদার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, এলডিপির শাহাদাৎ হোসেন সেলিম, সাংবাদিকনেতা আবদাল আহমেদ, আমিরুল ইসলাম কাগজী, খুরশেদ আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আ ফ ম ইউসূফ হায়দার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুল আলম সেলিম প্রমুখ।