যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে থাকবে মস্কো : রাষ্ট্রদূত
ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি বলেছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা যেকোনো সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে থাকবে রাশিয়া।
বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ বলেন রুশ রাষ্ট্রদূত।
আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি বলেন, ‘আমরা এখানে (বাংলাদেশ) যেকোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। আমরা এখানে আমেরিকা বা পশ্চিমা দেশগুলোর যেকোনো নিষেধাজ্ঞা বা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে থাকব।’
মান্তিৎস্কি বলেন, ‘রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ছাড়া কোনো পশ্চিমা দেশ কর্তৃক একতরফাভাবে আরোপিত কোনো নিষেধাজ্ঞাকে স্বীকৃতি দেয় না।’
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমা কোনো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে মস্কোর অবস্থান কী হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘ধারণ করা যায়, এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। দেখা যাক কী হয়।’
বাংলা ট্রিবিউনের কূটনৈতিক প্রতিবেদক শেখ শাহরিয়ার জামানের সঞ্চালনায় স্বাধীনতা সাংবাদিক ফোরাম ‘টকস উইথ অ্যাম্বাসেডর’ শিরোনামের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) যুগ্ম সম্পাদক খায়রুল আলম।
আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে কি না, জানতে চাইলে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি আরও বলেন, ‘রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা গত মাসে কথা বলেছেন, বেশ কয়েকবার মস্কো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কথা বলেছে।’
মান্তিৎস্কি বলেন, ‘তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামকে সরাসরি সমর্থন করেছিল এবং বর্তমান রাশিয়া অর্থপূর্ণ ও সম্মানজনকভাবে ঢাকার সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরের (তৈরি পোশাক খাত) বৈশ্বিক খ্যাতি সত্ত্বেও রাশিয়ার বাজারে এর প্রবেশাধিকার কম ছিল, কিন্তু অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাশিয়ার ব্যবসায়িক মহল ২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশসহ নতুন সরবরাহকারীদের সন্ধান করছে।’
রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ তাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আশা করেন, মেগা প্রকল্পটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
মস্কো দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সরবরাহ, প্ল্যান্ট রক্ষণাবেক্ষণ এবং পারমাণবিক বর্জ্য পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ উল্লেখ করে আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি বলেন, ‘আমরা পারমাণবিক প্রকল্পটির পুরো মেয়াদজুড়ে আমাদের বাংলাদেশি অংশীদারদের সহায়তা করব।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘রাশিয়ার লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি সম্পূর্ণ পারমাণবিক সেক্টর, একটি শান্তিপূর্ণ পরমাণু শিল্প তৈরি করা।’
রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি বলেন, ‘২০২২ সালে রাশিয়ার জেএসসি গ্লভকোসমস এবং বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড বঙ্গবন্ধু-২ পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট সিস্টেম তৈরি ও উৎক্ষেপণসহ বাংলাদেশে রাশিয়ান মহাকাশ শিল্প পণ্য ও পরিষেবার প্রচারে সহযোগিতার জন্য একটি স্মারক স্বাক্ষর করেছে।’
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘প্রকল্পের প্রযুক্তিগত দিকগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে জন্য বাণিজ্যিক প্রস্তাবনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি বলেন, ‘বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের পরে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং এমনকি কোভিড-১৯ মহামারিও এতে বাধা হয়নি। ২০২১ সালে বাণিজ্যের পরিমাণ ২৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। কিন্তু, ২০২২ সালে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবৈধ একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য লেনদেন ৬৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস পায়।’
রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেন, রাশিয়া-বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ আবার ২০২১ সালের সূচকের কাছাকাছি পৌঁছবে। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া বাংলাদেশে গম ও সার রপ্তানি বাড়িয়েছে। রাশিয়ার কোম্পানিগুলো জিটুজি ভিত্তিতে এক মিলিয়ন টন শস্যের পাশাপাশি প্রতি বছর পাঁচ লাখ টন পটাসিয়াম ক্লোরাইড সরবরাহ করতে প্রস্তুত রয়েছে।’
আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি বলেন, ‘মস্কো নির্মাণ, কৃষি ও আতিথেয়তা খাতে আরও বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রথম ব্যাচ ইতোমধ্যে রাশিয়ার প্রিমোরি টেরিটরিতে জাহাজ নির্মাণ ও নির্মাণশিল্পে কাজ করার জন্য রাশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছে।’
ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘মস্কো বিশ্বাস করে, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হওয়া উচিত নয়, বরং আসিয়ান, আইওআরএ, সার্ক ও বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার অঞ্চল হওয়া উচিত। কিন্তু, রাশিয়া দুর্ভাগ্যবশত সম্প্রতি অঞ্চল-বহির্ভূত গোষ্ঠিকে তাদের নিজস্ব সংকীর্ণ স্বার্থগত উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে বিদ্যমান শৃঙ্খলকে পুনর্বিন্যস্ত করার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা করতে দেখছে।’
যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটি ‘অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের’ ধারণাটির ঐক্য গড়ার পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও সতর্ক করেন আলেকজান্ডার মান্তিৎস্কি।
রাষ্ট্রদূত অভিযোগ করেন, ‘মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের আসল লক্ষ্য হলো এ অঞ্চলের দেশগুলোকে কোয়াড ও এইউকেইউএসের মতো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা এবং আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের আঞ্চলিক ব্যবস্থার বহুপক্ষীয় নীতিগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া, যাতে ওয়াশিংটনের নিজস্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়।’