মজুদবিরোধী অভিযানে কমছে ধান-চালের দাম
মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর নওগাঁয় ধান-চালের মূল্য কিছুটা নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। তিন দিনের ব্যবধানে নওগাঁর বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম কমেছে ৬৫ থেকে ১০০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে কমেছে ২ টাকা পর্যন্ত। তবে নওগাঁর খুচরা বাজারে এখনও আগের দামেই চাল বিক্রি হচ্ছে।
মজুদবিরোধী অভিযানের ভয়ে চালকল মালিক ও ধানের আড়তদাররা স্থানীয় বাজার থেকে ধান কেনা কমিয়ে দেওয়ায় ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। এদিকে হঠাৎ করে ধানের দাম প্রতি মণে ৬৫ থেকে ১০০ টাকা কমে যাওয়ায় হতাশ কৃষকরা।
গত মঙ্গলবার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুদ করায় ১৫ জন ব্যবসায়ীকে ছয় লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রম্যমাণ আদালত। অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে এ অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালকলের পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতা ও ধান-চাল ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স ক্যাপাসিটি অনুযায়ী যে পরিমাণ ধান-চাল মজুদ রাখতে পারবেন তা সব সময় ঠিক থাকে না। বাজারের প্রবাহের কারণে অনেক সময় গুদামে নির্দেশ করা ধারণক্ষমতার চেয়ে ধান-চাল বেশি মজুদ হয়ে যায়। আবার অনেক সময় নির্দেশিত ধারণক্ষমতার চেয়ে মজুদ কম থাকে। মৌসুমের সময় বেশি ধান-চাল মজুদ করে বছরের অন্য সময় ধান-চালের ব্যবসাটা চালু রাখেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সরকারের অভিযানের ফলে ধান-চাল আর মজুদ করতে চাইছেন না মিলমালিকরা।
এ ছাড়া মজুদবিরোধী অভিযানের ফলে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় বাজারের চাল ব্যবসায়ীরা মোকাম থেকে চাল কেনা কমিয়ে দেওয়ায় বাজার থেকে ধান কেনা কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মিলাররা।
কৃষিপণ্য বিপণন আইন-২০১৮ (সংশোধিত) অনুযায়ী, অটোমেটিক, হাসকিং ও মেজর চালকলের মালিকরা তাদের পাক্ষিক (১৫ দিন) ছাঁটাই ক্ষমতার তিন গুণ ধান ও দুই গুণ চাল ৩০ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবেন। পাইকারি ও খুচরা ধান-চাল বিক্রেতারা লাইসেন্স ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩০০ টন ধান ১৫ দিন ও চাল ৩০ দিনের জন্য মজুদ রাখতে পারবেন।
নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের মোকাম নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া বাজার। ওই বাজারে সপ্তাহে প্রতিদিন ধান কেনাবেচা হয়ে থাকে। আজ শুক্রবার ওই বাজারের আড়তদার ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারটিতে প্রতি মণ মোটা জাতের স্বর্ণা-৫ ও স্বর্ণা-৫১ (হাইব্রিড স্বর্ণা) ধান মান ভেদে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন দিন আগেও এসব ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২৬০ থেকে এক হাজার ২৭০ টাকা মণ দরে। বোরো মৌসুমের সরু জাতের জিরা ও কাটারিভোগ ধান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩২০ থেকে এক হাজার ৩৩০ টাকায়। তিন দিন আগেও প্রতি মণ জিরা ও কাটারিভোগ ধানের দাম ছিল এক হাজর ৪৫০ থেকে এক হাজার ৪৬০ টাকা।
মের্সাস আসিফ ট্রেডার্স নামের ধান আড়তের স্বত্বাধিকারী আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে ধানের দাম পড়তি। মোটা জাতের প্রতি মণ ধানের দাম গত তিন-চার দিনের ব্যবধানে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কমে গেছে। দাম কমার প্রধান কারণ হলো, মিলাররা ধান কিনছে না। আগে যেখানে প্রতি দিন একটা আড়ৎ থেকে পাঁচ থেকে ছয় ট্রাক ধান কিনত, এখন মিলাররা দিনে এক ট্রাক ধানও কিনছে না। মিলারদের চাহিদা না থাকায় আমরাও ধান কিনছি না। কারণ, বেশি ধান কিনে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মজুদ হয়ে গেলে জরিমানা দিতে হতে পারে। এই ভয়ে ধান কেনা কমিয়ে দিয়েছি।’
মহাদেবপুর উপজেলার সারথা গ্রামের কৃষক আকবর আলী (৪৫) বাজারে এসেছিলেন ধান বিক্রি করতে। কত দামে ধান বিক্রি করলেন জানতে চাইলে মলিন মুখে তিনি বলেন, ‘আর কইয়েন না ভাই। গত রোববারই এই বাজারে প্রতি মণ চিনিগুঁড়া ধান বিক্রি করে গেছি, দুই হাজার ৫০০ টাকায়। আজকে সেই ধান বিক্রি করতে হলো দুই হাজার ৩০০ টাকায়। চার দিনের মধ্যে ২০০ টাকা নাই হয়ে গেছে। এভাবে ধানের দাম উঠা-নামা করলে ক্যামনে চলবে।’
এদিকে নওগাঁর সবচেয়ে বড় চালের মোকাম আলুপট্টি ও মহাদেবপুর উপজেলা সদরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মোটা ও সরু জাতের চালের দাম ৫০ কেজির বস্তা ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, ‘মজুতবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে মোকামে চাল কেনা-বেচা প্রায় নেই বললেই চলে। আগে যেখানে একেকটা আড়ত থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় ট্রাক চাল বিক্রি হতো। এখন সেখানে এক ট্রাকও বিক্রি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী কম দামে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ গুদামে চালের মজুদ পেলে যে কোনো মুহূর্তে জরিমানা গুনতে হতে পারে।’
নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, নওগাঁর বড় ধানের হাটের মধ্য মধুইলহাট, ছাতরা বাজার, মাতাজি হাট, শিশা হাটসহ বিভিন্ন হাটে ধানের আমদানি নেই বললেই চলে। ‘স্থানীয় মিল মালিক ছাড়াও করপোরেট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোও গত কয়েক বছর ধরে প্রত্যন্ত এলকার হাট-বাজার থেকে ধান কিনছে। এ ছাড়া কিছু মানুষ আছে যারা ধান কিনে মজুদ করে রাখে তারাও স্থানীয় বাজার থেকে ধান কিনছে। বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় যত দিন যাচ্ছে ধান-চালের দাম ততই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এর যেমন সুফল আছে, তেমনি কুফলও আছে। ধান-চালের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে যাদের চাল কিনে খেতে হচ্ছে তাদের ভোগান্তি হচ্ছে। এই অবস্থায় আমার পরামর্শ সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই যেন স্বস্তিতে থাকতে পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সরকারকে।