চার কোটি টাকার সেতুতে ওঠা-নামায় লাগে বাঁশ-কাঠের মই!
নির্ধারিত সময় অতিক্রমের পর বারবার বাড়ানো হয় কাজের মেয়াদ। এর পরও শেষ হয়নি মুন্সিগঞ্জের চরমসুরা এলাকার মেঘনার শাখা খালের উপর সেতু নির্মাণ ও সংযোগ সড়কের কাজ। কাজ রেখে উধাও ঠিকাদার।
প্রতিদিন যাতায়াতে বিপাক-ভোগান্তি পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীসহ কয়েক গ্রামের হাজারো সাধারণ মানুষকে। সংযোগ সড়ক না থাকায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুতে উঠা-নামায় লাগে বাঁশ-কাঠে মই। এতে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। দ্রুত কাজ শেষ করার দাবি তাদের।
সেতু আছে, নেই সংযোগ সড়ক। মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের চরকেওয়ার ইউনিয়নে চরমসুরা নির্মিত সেতু এটি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের অক্টোবরে চার কোটি ২৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩৯ মিটার দীর্ঘ ও ২৪ ফুট প্রস্থের এ সেতু নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় টিএন-এএসআইয়ের একটি যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংযোগ সড়কসহ নির্মাণকাজ শেষ করে সেতুটি হস্তান্তরের কথা থাকলেও পরে নকশা জটিলতার কারণ দেখিয়ে বিগত বছরের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে দ্বিতীয় দফায় আবারও ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেন ঠিকাদার। এরপর কয়েক দফা নানা অজুহাতে সময় বৃদ্ধি করা হলেও নির্ধারিত সময়ে হয়নি নির্মাণকাজের সমাপ্তি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বরাদ্দকৃত অর্থে সেতুটি ৩৯ মিটার দীর্ঘ হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ হয়েছে ৩১ মিটার। দুই পাশের কোথাও প্রস্তুত হয়নি সংযোগ সড়কও। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
বাচ্চু মৃধা নামের স্থানীয় এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘প্রতিদিন অনেক কষ্ট করে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে দুটি গ্রামের বাসিন্দাদের, এ সেতু পার হতে ভয়ে ঘাম ছুটে যায় বয়স্কদের। আর নারী ও শিশুদের ভোগান্তি বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের ভোগান্তি কমানোর জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে সেতু বানাল। ঠিকাদাররা সংযোগ সড়ক না করায় সেতুটি আমাদের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিল। সেতুর চেয়ে আমাদের আগের বাসের সাঁকো ভালো ছিল।’
একই অভিযোগ আরো অনেকের। এদিন সাঁকো বেয়ে সেতুতে উঠতে না পেরে হামাগুঁড়ির মতো করে ওই খালে নামেন মুন্নি বেগম নামের এক নারী। সঙ্গে ছিল তার দুই বছরের ছেলে মনির হোসেন। খালের পূর্বপাশে ছেলেকে মাদ্রাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
মুন্নি বেগম বলেন, ‘সেতু বানানোর আগে যখন সাঁকো দিয়ে খাল পার হতাম তখনও এমন ভোগান্তি ছিল না। সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতু বানিয়ে আমাদের মতো নারী ও ছোট শিশুদের আরও বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে। খাড়া সাকোঁ বেয়ে সেতুতে উঠতে পারি না। খাল দিয়ে নেমে যেতেও পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। বৃষ্টি হলে এতে ঝুঁকি বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ।’
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সেতুটি মূল সড়ক থেকে অন্তত ১০-১১ ফুট উচুঁতে। সেতুর পূর্বপাশের উচ্চতা কাঁচা মাটির সড়ক থেকে অন্তত ১৫-১৬ ফুট উপরে। দুই পাশে সংযোগ সড়ক না থাকায় সেতুতে উঠা-নামা করতে বাঁশ-কাঠ দিয়ে তিনটি খাড়া সাঁকো বানানো হয়েছে। সাঁকো বেয়ে সড়কপথে যাতায়াত করছে মানুষ।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রফি উদ্দিন আহম্মেদ ফেরদৌস জানান, শিগগিরই শুরু হবে বাকি নির্মাণকাজ, তবে কেন দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
চরকেওয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভূইয়া বলেন, ‘কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়েও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ শেষ করেনি। বিগত বছর বর্ষার পরে সংযোগ সড়ক করে দেওয়ার কথা ছিল, তারা কোনো কাজ করছে না। সরকারের কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সেতুটি করা হয়েছে। ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে মানুষ সেতুর সুফল পাচ্ছে না। উল্টো দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। স্থানীয়দের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবে না।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে এলজিইডির প্রকৌশলী মো. শফিকুল আহসান বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে সেতুর কাজ বুঝিয়ে দিতে পারছে না। আমরা তাদের কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। তারা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছিল। এর পরও সেতুটি বুঝিয়ে দিতে পারেনি। ফের যোগাযোগ করা হলে তারা এক সপ্তাহের সময় নিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী চুক্তিপত্র বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।