চলতি বছর ডেঙ্গু আরও ‘ভয়ঙ্কর হতে পারে’
চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে এবং তা হতে পারে ভয়ঙ্কর৷ গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এই বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার দ্বিগুণেরও বেশি৷ গবেষণায় ঢাকাসহ ৯টি জেলায় ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার উচ্চঘনত্ব দেখা গেছে৷ আর ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার জানান, এই বছর ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, গাজীপুর, বরিশাল, বরগুনা ও মাদারীপুরে ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের চেয়েও বাড়বে৷ মার্চ মাসে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে দেখা গেছে, এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ওই জেলাগুলোতে আরো খারাপ হবে৷ আমরা ডেঙ্গু মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ডেঙ্গু রোগী এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেই৷ তাতে দেখা গেছে, এবার ওই জেলাগুলোতে শীতকালেও এডিস মশার ঘনত্ব ১০-এর উপরে৷ এটা মার্চ মাসের হিসেব৷ বৃষ্টি হলে এটা দ্বিগুণ হয়ে যায়৷ এবার আগাম বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ ধারণা করি এখন এডিস মশার ঘনত্ব দ্বিগুণ হয়ে গেছে৷ আর যদি রোগীর সংখ্যা বিবেচনা করি, ২০২৩ সালের তুলনায় এবছরের মার্চ মাসে দ্বিগুণেরও বেশি ছিল৷ ফলে আমরা যে তথ্য উপাত্ত পাচ্ছি তাতে ডেঙ্গু এবার অনেক প্রকট হবে৷”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছর প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ৯ জনের৷ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২২ জন যা গত বছরের একই সময়ে দ্বিগুণের বেশি৷ এ বছর একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি৷ গত বছর প্রথম তিন মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ৮৪৩ জন৷ এবার প্রথম তিন মাসেই ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৭০৫ জন৷
২০২৩ সালে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় এক হাজার ৭০৫ জন৷ গত বছর জুলাই-আগস্টের দিকে হঠাৎ ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় কোথাও কোথাও স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছিল৷ তখন স্যালাইনের দামও বেড়ে যায়৷ চলতি বছরে সেরকম পরিস্থিতি যাতে না হয়, সেজন্য গত ৩১ মার্চ বৈঠক করেছে স্বাস্থ্যবিভাগ৷
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জাহঙ্গীর আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘কৃত্রিম সংকট মোকাবিলা করতে চাহিদার চেয়ে বেশি স্যালাইন উৎপাদন হওয়া প্রয়োজন৷ এ কারণে উৎপাদন বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ এ ছাড়া সব হাসপাতালে এখন থেকে স্যালাইন কিনে মজুত রাখতে হবে৷ পাশাপাশি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ) চিকিৎসার জন্য প্ল্যাজমা ও রক্তক্ষরণ প্রতিরোধী ওষুধ আমদানি করা যায় কিনা, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে৷’
মার্চ থেকে অক্টোবরকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়৷ এ সময়ে সারাদেশে প্রতি মাসে স্যালাইনের চাহিদা থাকে প্রায় ৫০ লাখ লিটার৷ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ কম থাকে৷ ওই সময়ে এ ধরনের স্যালাইনের মাসিক চাহিদা থাকে প্রায় ৩০ লাখ লিটার৷
ডেঙ্গু ‘সারা বছরের’ রোগ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘‘ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসকরা এখন যথেষ্ঠ দক্ষ হয়ে উঠেছেন৷ হাসপাতালগুলোতেও ব্যবস্থাপনা এখন ভালো৷ তারপরও প্রস্তুতি প্রয়োজন৷ জেলা, উপজেলার সব হাসপাতালেরই আগাম প্রস্তুতি দরকার৷ সেই সঙ্গে দরকার মানুষকে সচেতন করা৷ তবে সমস্য হলো আগেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করে ডেঙ্গু রোগ যাতে না হয় তার ব্যবস্থা তেমন নেওয়া হচ্ছে না৷ আর এখন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে না গিয়ে অপেক্ষা করেন৷ রোগীর অবস্থা জটিল হলে হাসপাতালে যায়৷ ফলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুও হার বাড়ছে৷”
ডা. লেনিন বলেন, ‘‘ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ৷ এটা এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এডিশ মশার একটি ধরন হলো শহুরে এডিস৷ কিন্তু ২০১৯ সালের পর আমরা আরেকটি প্রজাতির এডিস মশা দেখতে পাচ্ছি যেটি বুনো এডিস৷ এটা বনে বাদাড়ে, গাছের কোটরে থাকে৷ ফলে এখন গ্রামেও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে৷”
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘‘এখন দেশের মানুষ ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে জানে৷ এডিস মশা চেনে৷ এই মশা প্রতিরোধে কী করতে হয় তাও জানে৷ জানার পরও তারা বাড়িঘর পরিস্কার করেন না৷ স্বচ্ছ পানি জমতে দেন৷ আর এই পানিতেই এডিস মশা জন্মায়৷ আর সিটি কর্পোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেই৷”
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই প্রতি বছর মশা মারতে তাদের বাজেট বাড়চ্ছে৷ কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না৷ ঢাকার দুই সিটির চলতি অর্থবছরে মশা মারার বাজেট ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা৷ এরমধ্যে উত্তরের ১২১ কোটি ৮৪ লাখ আর দক্ষিণের ৩১ কোটি এক লাখ টাকা৷ আর গত ১২ বছরে ঢাকার মশা মারার আয়োজনে খরচ হয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা৷ এই বাজেটের টাকা মশা নিবারণের নানা যন্ত্রপাতি, কীটনাশসহ আরও অনেক কাজে ব্যয় হয়৷
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) ১০টি অঞ্চলে ৭৫টি ওয়ার্ডে মশা নিধনে ১৫০ জন মশক সুপারভাইজারসহ এক হাজার ৫০ জন কাজ করছেন৷ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১০টি অঞ্চলে মোট ৫৪টি ওয়ার্ডর ৭৫ জন মশক সুপারভাইজারসহ প্রায় ৬০০ জন কাজ করছেন৷
এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘‘দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এখন ডেঙ্গু রোগী তেমন নাই৷ হাতে গোনা কয়েকজন পাওয়া গেছে৷ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে৷ এখন নিয়মিত মশা নিধনের কাজ চলছে৷ ঈদের পর আমরা আরও বড় পরিসরে কাজ শুরু করব৷ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ে কাজ করা হবে৷ সবাইকে চিঠি দেওয়া হবে৷ সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হবে৷”
ডা. ফজলে শামসুল কবির আরও বলেন, “এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু আমরা নয়, সবাইকে কাজ করতে হবে৷ বাড়ির ভিতরে গিয়েতো আর মশা নিধন করতে পারব না৷ তাই এবার আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব৷ কোনো বাড়ি বা স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে৷”
এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘মশা নিধনে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে৷ এটা আরও জোরদার করা হচ্ছে৷ তবে বাসাবাড়ির জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্মায়৷ তাই বাসা বাড়ির ছাদ, বারান্দা, বাথরুম এগুলো পরিষ্কার ও রাখতে হবে৷ সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে৷”
এজন্য দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ছাড়াও পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি নগরবাসীর কাছ থেকে নগদ মূল্যে সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে মেয়র জানিয়েছেন; যাতে ওইসবের ভিতর পানি জমতে না পারে৷ পরিবেশও রক্ষা পায়৷ পাশাপাশি মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হবে৷