ইইউর নতুন বিধান : পোশাক শিল্পে সংকটের শঙ্কা
কারখানাসহ পণ্য সরবরাহ ও বিপণনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নতুন একটি বিধান পাস করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট৷
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ৷ তাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নতুন এই বিধিবিধান পাস হওয়ার ফলে সংকটে পড়বে দেশের অন্তত অর্ধেক গার্মেন্ট৷ মালিকরা বলছেন, এই শর্তগুলো পূরণ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন৷ এখন তারা যদি আর্থিকভাবে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, তাহলে দ্রুতই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে৷
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো এতদিন তাদের সব শর্ত মেনেই পোশাক রপ্তানি করে আসছি৷ বিশেষ করে রানা প্লাজার ঘটনার পর আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে৷ আমরা আস্তে আস্তে সবগুলো ফ্যাক্টরিকেই গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরের চেষ্টা করছি৷ আশা করি নতুন যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলোও আমরা সঠিক সময়ের মধ্যে করে ফেলব।”
গত বুধবার ইইউ পার্লামেন্টে নতুন এই ‘অবশ্যপালনীয়’নির্দেশনার ওপর ভোটাভুটি হয়৷ এর পক্ষে ৩৭৪ ও বিপক্ষে ২৩৫ ভোট পড়ে৷ ১৯ জন এমপি ভোটদানে বিরত ছিলেন৷ এই বিধানের ফলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি তারা যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করে, সবার জন্য নতুন বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে৷ এর ফলে কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি প্রতিরোধ, নির্মূল ও প্রশমনে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এর মধ্যে রয়েছে দাসত্ব, শিশুশ্রম, শ্রমশোষণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, দূষণ ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষতি প্রতিরোধ, বন্ধ ও কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ৷
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র পরিচালক শহীদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইইউ পার্লামেন্টে নতুন বিধান পাস হয়েছে, এটা সবার জন্যই ভালো৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো এই কাজগুলো করতে গেলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন৷ এই টাকা কে দেবে? তারা তো আর্থিকভাবে আমাদের কোনো সহযোগিতা করে না৷ মাঝে মধ্যেই নতুন বিধিবিধান নিয়ে হাজির হয়৷ সেগুলো বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়৷ রানা প্লাজার ঘটনার পর তারা আমাদের যে সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছিল, সেটা করতে ছোট ফ্যাক্টরিরও ৫-৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে৷ এখন তারা যদি আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে ভালো৷ সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ না হলে অর্ধেক ফ্যাক্টরি ভয়াবহ সংকটে পড়বে৷”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই বিধান কার্যকর হলে বাংলাদেশে এর কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ইইউর এই বিধানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই আছে৷ ইতিবাচক দিক হচ্ছে ইইউর সব দেশের ব্র্যান্ডগুলো উন্নত কর্মপরিবেশের দিকে নজর দেবে৷ মানবাধিকার ও শ্রমিকের অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকায় খুব বেশি চ্যালেঞ্জ হবে না৷ আর নেতিবাচক দিক হচ্ছে ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র পণ্য সরবরাহকারীরা ব্যবসা থেকে ছিটকে যেতে পারেন৷ এই ধরনের ফ্যাক্টরির সংখ্যাও কম না৷”
ইউরোপীয় কোম্পানির পাশাপাশি ওই সব দেশে ব্যবসা করা বাইরের কোম্পানিগুলোর ওপরও এই বিধান কার্যকর হবে৷ কোম্পানিগুলোকে অবশ্যপালনীয় বিষয়গুলোকে তাদের নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে৷ বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলো প্রতিপালনে বিনিয়োগ করতে হবে৷ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে এসব বিষয় মেনে চলা হচ্ছে কিনা, তার নিশ্চয়তা চাইতে হবে৷ ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়িক অংশীদারেরা যাতে নতুন বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে পারে, সে জন্য তাদের সহায়তায় ব্যবসা পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে৷ ব্যবসা মডেল যেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেদিকে কর্যক্রম নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷
কঠোর এই বিধিবিধান প্রতিপালনে কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টর? এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে৷ এর অন্যতম হলো আগে আমরা পণ্যের মান নির্ণয় করতাম৷ এখন পণ্য থেকে প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে৷ অর্থাৎ, পণ্য উৎপাদন যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু৷ একেবারে উৎসমুখে যেতে হচ্ছে৷ এই আইনটা হচ্ছে, সেটাই৷ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মনোভাবের যে পরিবর্তন সেদিকেই নজর দেওয়া হয়েছে৷ এখন আমাদের উৎস থেকে উৎপাদন পর্যন্ত সব জায়গাতেই তাদের দেওয়া মানদণ্ড মেনে চলতে হবে৷ পণ্যের মানের পাশাপাশি এর সঙ্গে যে মানুষগুলো জড়িত, তাদের যে অধিকার আছে সে বিষয়ে শক্তভাবে নজর দিতে হবে৷”
ইইউর নতুন বিধান কোম্পানিগুলো মানছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা এবং বিধান লঙ্ঘনের জন্য কোম্পানিকে দণ্ড দেওয়ার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলো৷ যেসব কোম্পানি বিধান লঙ্ঘন করবে, তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ওই কোম্পানির মোট লেনদেনের ৫ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে৷ এ বিষয়গুলোতে সহযোগিতা ও সর্বোত্তম চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ইউরোপীয় কমিশনও একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে৷ অবশ্য পালনীয় বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হলে যে ক্ষতি হবে, তার দায় কোম্পানিকে নিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইর সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আশপাশের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ অনেক ভালো৷ আমরা তো তাদের শর্তগুলো মেনেই ফ্যাক্টরিকে নতুনভাবে সাজিয়েছি৷ এখন এই বিধিবিধানের ফলে যেটা হবে, বেশ কিছু ছোট গার্মেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে৷ আমাদের যে এক্সপোর্ট তার অর্ধেকের বেশি করে ২৫ ভাগ ফ্যাক্টরি৷ বাকি অর্ধেক করে ৭৫ ভাগ ফ্যাক্টরি৷ এই ৭৫ ভাগই বেকায়দায় পড়বে৷ এ থেকে পরিত্রাণের পথ যদি বলেন, তাহলে বায়ারদের এগিয়ে আসতে হবে৷ পাশাপাশি আমাদের সরকারকেও ভূমিকা নিতে হবে৷”
ইইউর এই বিধিবিধান সম্পর্কে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো ইইউর এই উদ্যোগকে খুবই সাধুবাদ জানাই৷ কারণ, এতে আমাদের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ যেমন ভালো হবে, তেমনি তাদের স্বার্থের বিষয়টি নিশ্চিত হবে৷ পাশাপাশি আমরা এটাও বলতে চাই, এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন৷ সেই টাকা যেন বায়াররাও দেন৷ আমাদের মালিকদের এটা নিয়ে কথা বলতে হবে৷ সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে৷ কিছু ফ্যাক্টরি হয়ত নিজেদের উদ্যোগেই করতে পারবে৷ কিন্তু অনেক ফ্যাক্টরি সংকটে পড়বে৷ আমাদের ফ্যাক্টরি যদি তিন হাজার হয়, তাহলে অর্ধেক অর্থাৎ দেড় হাজার ফ্যাক্টরির এসব শর্ত পূরণের সামর্থ্য নেই৷ তাদের সহযোগিতা দিয়ে কাজগুলো করতে হবে৷ তাহলেই মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে৷”