চলতি বছর বাড়তে পারে বজ্রপাত, প্রাণহানি বাড়ার আশঙ্কা
বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা এবং বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা দুইটিই বেড়ে চলেছে৷ গরম বেশি হওয়ায় চলতি বছর বেশি বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদেরা৷ গত বৃহস্পতিবার (২ মে) প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে ১১ জনের মুত্যু হয়েছে৷ আর চলতি বছরে এ পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ২২ জন বলে জানিয়েছে ডিজাস্টার ফোরাম নামে একটি সংস্থা৷
আবহাওয়াবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার তাপ বেশি হওয়ার কারণে বজ্রপাত বেশি হবে৷ আর একইসঙ্গে বর্ষাকালের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি হবে৷ অন্যদিকে বজ্র প্রতিরোধ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও অসচেতনতার কারণে মৃত্যুও বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে৷ ডিজাস্টার ফোরাম বলছে, বালাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু এড়াতে আগাম সতর্কতা ও আবহাওয়া বার্তা খুব জরুরি৷
ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘কক্সবাজারে বৃহস্পতিবার নিহতদের মধ্যে তিনজন বজ্রপাতে মারা গেছেন৷ লবণ ক্ষেতে বৃষ্টির সময় লবন ঢেকে দিতে গিয়েছিলেন তারা৷ বৃষ্টি যে আসবে তা আগে থেকেই বলা হচ্ছিল৷ তাদের আগে থেকেই সতর্ক করা যেত৷ তাদের আগেই লবণ ক্ষেত ঢেকে দেওয়ার জন্য সচেতন করা যেত, সেটা করা হয়নি৷’
পিয়ার-রিভিউ জার্নাল হেলিয়নে ‘বাংলাদেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির ওপর জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম) ভিত্তিক স্থানিক বিশ্লেষণ’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ প্রাণহানি বর্ষা পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষা ঋতুতে ঘটে, যার মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা৷ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরন ও বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে৷ যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ ও ঋতু পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে৷ এ কারণেই বজ্রপাত বাড়ছে৷
ওই গবেষণার বাংলাদেশে প্রধান গবেষক অধ্যাপক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এবার বজ্রপাতের আশঙ্কা বাংলাদেশে বেশি৷ মেঘের সঙ্গে তাপের একটা সম্পর্ক আছে৷ তাপ বেশি হলে মেঘে কেমিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল প্রোপার্টি বেশি হবে৷’
ফেরদৌস আহমেদ আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে বর্ষা শুরু হয় আগস্টের শেষের দিকে৷ কিন্তু এবার আগেই শুরু হয়ে গেছে৷ গত মার্চেই ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে৷ ফলে এবার বজ্রপাত বেশি হতেই পারে৷’
অধ্যাপক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘বজ্রপাতে হতাহত বাড়ার পেছনে আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীতা কাজ করেছে৷ বৃটিশরা আমাদের এখানে ফসলের ক্ষেতে বড় বড় কপার দণ্ড লাগিয়েছিল৷ কিন্তু আমরা সেগুলো তুলে অর্থের লোভে বিক্রি করে ফেলেছি৷’
জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০০ জন বজ্রপাতে মারা যায়৷ সেখনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মারা যায় বছরে গড়ে ২০ জনেরও কম৷ বাংলাদেশে গাছপালা কেটে ফেলা, বিশেষ করে খোলা মাঠে উঁচু গাছ ধ্বংস করে ফেলা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া এবং অসচেতনতার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে৷
ফিনল্যান্ডের বজ্রপাত বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে যারা মারা যান, তাদের ৭০ ভাগই কৃষক বা যারা খোলা মাঠে কাজ করেন৷ এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে ১৪ শতাংশ এবং গোসল ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের বজ্রপাতের ফলে মৃত্যু হয়৷
গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘আমাদের এখানে বজ্র নিরোধে তাল গাছ লাগানো প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। কারণ যেখানে তাল গছ লাগানো দরকার, আমরা সেখানে লাগাইনি৷ আসলে শুধু তাল গাছ নয়, যেকোনো উঁচু গাছ বজ্র নিরোধে সহায়তা করে৷ আসলে আমাদের গাছ লাগানোর চেয়ে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে৷ এখন জুন মাসে নড়াইলে তাল গাছের ডোঙার (এক ধরনের নৌকা) হাট বসবে৷ প্রতিবছর সেখানে ১০ থেকে ১৫ হাজার ডোঙা বিক্রি হয়৷ একটা তাল গাছে দুইটা ডোঙা হয়৷ তাহলে সাত-আট হাজার তাল গাছ কাটা হবে এক মৌসুমে৷ নড়াইলের ডিসি চাইলে কিন্তু এটা বন্ধ করতে পারেন৷’
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের গবেষণা সেলের প্রধান আবদুল আলীম বলেন, ‘বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ দুটি৷ বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গাছ বিশেষ করে মাঠের উঁচু গাছ কেটে ফেলা৷ হাওর অঞ্চলের মাঠে আগেও তেমন গাছ ছিল না৷ এখন অন্যান্য এলাকার গাছও কেটে ফেলা হয়েছে৷ ফলে মাঠে বা খোলা জায়গায় যেসব মানুষ থাকেন, বজ্রপাতের এক কিলোমিটারের মধ্যে বিদুৎ পরিবাহী উঁচু জিনিস হিসেবে সেই মানুষকেই পায়৷ মানুষ না থাকলে মাঠের গবাদি পশু৷ ফলে মানুষ মারা যায়, গবাদি পশুও মারা যায়৷’
আবদুল আলীম আরও বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, ওই সময় গাছের তলায় আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ৷ আসলে এটা ঠিক নয়৷ আশ্রয় নিতে হবে বাড়িঘরে বা পাকা স্খাপনার নিচে৷’
গবেষক আবদুল আলীম বলেন, ‘সানাতন পদ্ধতিতে লাইটেনিং অ্যারেস্টার লাগালে বজ্রনিরোধ করা যায়৷ এতে খরচ কম৷ একটি বাড়িতে ১০ হাজার টাকা খরচ করেই লাগানো যায়৷ আর সরকার হাওড় ও খোলা জায়গায় এগুলো লাগানোর উদ্যোগ নিতে পারে৷’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর ৩০০ জনের বেশি মারা যাচ্ছে বজ্রপাতে৷ এটা অ্যালার্মিং৷ আমরা লাইটেনিং আ্যরেস্টার লাগানোর একটা পরিকল্পনা নিয়েছি৷ কিন্তু এটা এখনও প্ল্যানিং কমিশন পাস করেনি৷ আর কত জায়গায় এটা লাগাতে হবে তারও কোনো সমীক্ষা নেই৷ এটা বেশ কস্টলি৷ আর আমাদের যে আশ্রয়কেন্দ্র সারা দেশে আছে, সেগুলোকে বজ্রপাতের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করছি৷ নতুন আশ্রয়কেন্দ্রও হবে৷ তবে সবগুলোই আন্ডার প্রসেস বলতে পারেন৷’
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, তারা বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা পাঠাতে আটটি বজ্রপ্রবণ জেলায় বজ্রপাত শনাক্তকরণ সেন্সর স্থাপন করেছে৷ আর একটি পাইলট প্রকল্পের কাজ চলছে, যাতে নির্দিষ্ট এলাকায় উপস্থিত লোকজনকে বার্তা পাঠানো যায়৷
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘কুমিল্লা, নোয়াখালি, যশোর , কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, সিলেট ও ঢাকা বিভাগ আগে বজ্রপ্রবণ ছিল৷ এখন সারা দেশেই বজ্রপাত হয়৷ আর এই সময়ে যদি বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে বজ্রপাত অবধারিত৷ তাই মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে৷’
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই সময় তাপ বেশি থাকার কারণে বজ্র মেঘ তৈরি হয় বেশি৷ আর এই মেঘের স্থায়িত্ব সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা৷’