আলতাদীঘি পুনঃখননের নামে নির্বিচারে গাছ কাটার অভিযোগ
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় ‘পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ প্রকল্পের জন্য দীঘিটির চতুর্দিকের কয়েক হাজার গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবাদকারীদের অভিযোগ, কিছু দিন আগেও আলতাদীঘি ছিল সবুজের আভা। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এখন খাঁ খাঁ করছে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান। সম্প্রতি উদ্যানের দীঘি খনন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ ও গাছ রোপণসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। যা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাটা পড়ে নানা প্রজাতির হাজারও গাছ।
জয়পুরহাট সরকারি কলেজের ভূগোল বিষয়ে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র সাদমান সাকিব বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আলতাদীঘি দেখতে। গতকাল সোমবার (৭ মে) বিকেলে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দীঘিটি অবশ্যই সংস্কার জরুরি কিন্তু তাই বলে এভাবে নির্বিচারে চর্তুদিকের সারিবদ্ধ সব গাছ কাটতে হবে? গাছগুলো রেখে কি সংস্কার করা যেত না? দীঘির চতুর্দিক দেখে এটাকে আর দীঘি বলা যায় না। এ যেন এক মরুভূমি।
উদ্যানের উন্নয়ন কাজে গঠিত কমিটির সদস্য কায়েস উদ্দিনের দাবি, আলোচনা সভায় গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, হঠাৎ করে আলতাদীঘিতে এসে দেখি গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।
তবে ধামইরহাটের বনবিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলছেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। নতুন বনায়ন হবে, একটা গাছ তো আর সারাজীবন থাকবে না। এটি সামাজিক বনায়নের অওতায় স্বল্প মেয়াদি সৃজিত উডলট বাগান।
বন বিভাগ বলেছে, সামাজিক বনায়নের আওতায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়ন করা গাছগুলো অপসারণ করে স্থানটি দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আলতাদীঘির খনন করা মাটি দিয়ে নিচু স্থান ও পাড় সংস্কার করার জন্য দীঘির চারপাশে বিদ্যমান ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিগাছ যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ১৫টি লটে ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকায় টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়।
এখানে ঘুরতে আসা নওগাঁ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘গাছ কাটার আগে এসব জায়গাতে বেশ কিছু পাখির বাসা দেখেছি। এখন সেখানে বালুর স্তূপ। এগুলো মেনে নেওয়া যায়?’
পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই অজুহাতে ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার বিষয়টি হয়তো মেনে নেওয়া যায় তবে দীঘির চতুর্দিকে সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো পরিবেশবান্ধব বিশাল আকৃতির ৪৫৬টি আকাশমনি গাছ কাটার বিষয়টি অযৌক্তিক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নওগাঁ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সৌন্দর্যবর্ধন বৃক্ষরোপণের মধ্যে নিহিত, নিধনে নয়। আজকের কাটা গাছগুলো হতে সময় লেগেছে ১৫ থেকে ২০ বছর। অথচ নিমিষের মধ্যে তা ধ্বংস করা হচ্ছে। আধুনিক নকশায় গাছ রেখেই সুন্দর পরিকল্পনা করা সম্ভব।’
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান এ অঞ্চলে ফুসফুসের মতো কাজ করে। আমরা এ বিষয়ে অনেক মিটিং, মিছিল ও মানববন্ধন করেছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। পুরোনো হাজার হাজার গাছ যারা নির্বিচারে কাটছে তারা অবশ্যই অপরাধ করছে। এসব উদ্দেশ্য প্রণোদিত।’
রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান এ বিষয়ে জানিয়েছেন, ‘আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত আলতাদীঘিটি দীর্ঘদিন ধরে খনন ও সংস্কার না করায় দীঘিটির গভীরতা কমে গিয়ে প্রায় এক ফুট উচ্চতার নিচে পানি ছিল এবং চারপাশের পাড়গুলো ভেঙে যাওয়ায় দীঘিটি পুনঃখনন ও পাড় সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছিল।তাই জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ৬৪৯.৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বন অধিদপ্তর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মাধ্যমে দীঘিটির খনন কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। খনন করা মাটি দিয়ে দীঘিটির চারপাশের পাড় মেরামত ও উঁচুকরণ করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। আলতাদীঘির পাড়জুড়ে সামাজিক বনায়নের আওতায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়ন করা গাছগুলো অপসারণ করে স্থানটি দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়।’
রফিকুজ্জামান আরও বলেন, আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের চারপাশে বিদ্যমান গাছগুলো স্থান উপযোগী না হওয়ায় কেটে দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা চলতি অর্থবছরের বর্ষাকালে বনায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দীঘিটি ২ দশমিক ৫০ মিটার খনন করা হয় এবং বর্তমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খড়ার কারণে দীঘিটি শুকিয়ে যায়।’
‘সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ সুরক্ষা প্রকল্পের’ মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন আলতাদীঘির জলাশয়ের চারপাশে ২ মিটার প্রস্থ ইটের সোলিং এবং পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। এ জন্য দীঘির পাড়ের ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছগুলো কেটে আলতাদীঘির চার পাশের পাড় মেরামত ও উঁচু করা হয়েছে।
রফিকুজ্জামান জানান, দেশীয় প্রজাতির ৩০ হাজার চারা দ্বারা দীঘিটির চারপাশে বনায়নসহ দীঘিটিতে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চলতি অর্থবছরের নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে সমাপ্ত হলে পুরো আলতাদীঘি এলাকা আবারও সবুজে পরিণত হতে শুরু করবে। দীঘির পানির পাপ্যতা নিশ্চিত ও বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি পরিবেশের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন এবং ইকো টুরিজমের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
আলতাদীঘির নামকরণেও রয়েছে ঐতিহাসিক মজার ঘটনা। অনেক অনেক দিন আগের কথা। এ এলাকা ছিল বটু রাজার। জগদ্দলে ছিল সেই রাজার বাড়ি। তাঁর ছিল এক দয়াবতী রানি। রানি একদিন আবদার করলেন, তাকে বড় একটা দীঘি খুঁড়ে দিতে হবে। রাজা বললেন, ঠিক আছে। তুমি হাঁটতে শুরু করো। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার পা ফেটে রক্ত বের না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত হাঁটতে হবে। এখান থেকে হাঁটা শুরু করে যেখানে গিয়ে পা থেকে রক্ত বের হবে সেই পর্যন্ত দীঘি কাটা হবে। রানি হাঁটতে থাকলেন। হাঁটা আর শেষ হয় না। রাজা পড়ে গেলেন চিন্তায়। শেষ পর্যন্ত পাশের দেশে গিয়ে দীঘি কাটতে না হয়। তাই কৌশলে তার সৈন্য দিয়ে রানীর পায়ে আলতা লাগিয়ে বললেন, রানির পা ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। দীঘি সে পর্যন্তই খোঁড়া হলো। ধীরে ধীরে সে দীঘি ভরে গেল টলটলে কাকচক্ষু জলে। তাতে পদ্ম ফুটল। প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট শেষ হলো। আর সে থেকেই এর নাম হয়েছে আলতাদীঘি। প্রায় হাজার বছরের স্মৃতি নিয়ে আজও সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী আলতাদীঘি।
এত প্রাচীন আর এমন বিশাল দীঘি বাংলাদেশে আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ দীঘির দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার, চওড়া প্রায় ৪০০ মিটারের মতো। গ্রামের লোকমুখে প্রচলিত আছে বৌদ্ধ যুগের কীর্তি এটি। দীঘির পাড় ঘেঁষে ভারত সীমান্ত। উত্তর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া, বিএসএফের সীমান্ত টইল, পাশের দেশ ভারতকে দেখা খুবই সহজ। আলতাদীঘির পাড়ে দাঁড়ালে মনে হবে অনেকটাই সুন্দরবনের মতো, শীতের সময় এখানে অতিথি পাখির আগমন ঘটে।