তথ্য-উপাত্ত নিয়ন্ত্রণের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনামহানি হয়েছে : ড. দেবপ্রিয়
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, তথ্য-উপাত্তের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনামহানি হয়েছে। আমদানি তথ্য নিয়ন্ত্রণ করা হলেও, এ তথ্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পেলে বাজারে সিন্ডিকেট হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (৭ মে) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে প্রয়াত সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন স্মরণ ও ‘ব্যাষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ এবং এগিয়ে যাওয়ার উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এ আশঙ্কার কথা জানান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের কারিগরি সক্ষমতা থাকায় এখন ইউটিউবকেও ধীর করে দেওয়া যায়। এভাবে এই প্ল্যাটফর্মটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একইভাবে তথ্য-উপাত্তের সঞ্চালনকেও ধীর করে দেওয়া যেতে পারে। যা দুই মাস আগে পাওয়ার কথা তা আমি এক বছর পর আপনার হাতে দেবো। তাহলে সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করার সুযোগ হবে না।
আমদানির তথ্য শুধু ব্যবসায়ীরা পেলে তাতে সিন্ডিকেট হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যদি এমন হয় আমদানির তথ্য পণ্য অনুযায়ী আপনি পাচ্ছেন না। আর এটি গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যারা আমদানি করছেন তারা যদি পায়, সিন্ডিকেট কাকে বলে বুঝেছেন। আপনি তথ্য-উপাত্তকে নিয়ন্ত্রণ করছেন জনমানুষের কাছে। বাজারে যেতে দিচ্ছেন না। কিন্তু আমদানিকারক সেই তথ্য পেয়ে যাওয়া মানে বাজারে তার সুবিধা বেড়ে গেলো।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মুদ্রানীতি ও আর্থিকনীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। এটা দূর করতে হবে। একইভাবে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহারে নমনীয়তা আনতে হবে। রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে স্থানীয় শিল্প মালিকরা বিদেশে শিল্পের কাঁচামাল কিনছেন। এভাবে ২ বা ৩ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে আরও নমনীয় হতে হবে। সুদহারেও নমনীয়তা আনতে হবে। মুদ্রানীতি ও আর্থিকনীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে, সেটা দূর করতে হবে অর্থনীতির স্বার্থে।
দেবপ্রিয় আরও বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চারটি ঘাটতি রয়েছে। ফলে জিডিপির আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বোয়িংয়ের চলার মতো। সরকারের বিনিয়োগ থেকে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। আমাদের দ্বিতীয় ঘাটতি হলো রাজস্ব আয়ে। জিডিপি বাড়লেও আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। আবার বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে। অতিমূল্যায়িত প্রকল্প গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বাংলাদেশ এতদিন গর্বের সঙ্গে দাবি করতো যে দেনা পরিশোধে কখনও খেলাপি হয়নি। সে দাবি এখন আর থাকছে না। ঋণ পরিশোধ করতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জ্বালানির বিল, বৈদেশিক কোম্পানির মুনাফা, বিদেশি এয়ারলাইন্সের পাওনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫ বিলিয়ন ডলার যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মাধ্যমে একধরনের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে বলেও মনে করেন দেবপ্রিয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে একধরনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তা হলো ওই তথ্য-উপাত্ত এমন তা যদি জনসম্মুখে প্রকাশ পায়, তাহলে বড় ধরনের নাশকতা হবে। সেই নাশকতাকারীরা হলো অর্থনীতি সাংবাদিকেরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক একসময় তথ্য-উপাত্তের জগতে শক্তিশালী স্তম্ভ ছিল জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত তাৎক্ষণিক ও সমসাময়িক ছিল, বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। ইপিবি, অর্থ মন্ত্রণালয় ইত্যাদির তথ্যের চেয়েও অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে। বিবিএসের তথ্য আসার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অনেক অনুমান ও প্রাক্কলন তৈরি করেছি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নিজেকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনামহানি হয়েছে। আমি জানি না এ নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকের বোর্ড করেছে কি না, নাকি উনারা নির্দেশিত হয়েছেন আরও উচ্চ পর্যায় থেকে। কিন্তু এটার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনাম যেটা ছিল তার হানি ঘটবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আলোচনা সভায় ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।