এলাকাছাড়া হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া শিশুশিল্পী ফারজিনার পরিবার
‘নিজের বসতবাড়ি নাই, ভাবছিলাম সরকারের দেয়া জমিত ঘর বানাইয়া নিজের এলুকাত থাকমু, কিন্তু গত কয়টা মাস, এই অফিস তিকি হেই অফিস দৌড়তে দৌড়তে জানের খাম শেষ, কুনতাই অইলো না' ফোনে এভাবে নিজের অভিমান আর হতাশার কথা বলছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুশিল্পী ফারজিনার বাবা মো. সায়েম।
আজ সোমবার (১৩ মে) মো. সায়েম সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে ফারজিনাসহ পরিবার নিয়ে সিলেট শহরে চলে গেছেন।
কেন চলে গেলেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুশিল্পী ফারজিনার বাবা বলেন ‘বালা নাই, নিজের ঘর না থারিয় উরা বাইন্দা আসলাম। ঘর ফাইমু ফাইমু এই আশায় আসলাম কিন্তু শেষমেশ আশাহত অইয়া নিজের এলাকা ছাইরা ফারজিনাসহ পরিবার লইয়া জীবিকার আশায় সিলট আইচ্ছি।’
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের দুর্গম এক গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে ফারজিনা আক্তার (৯)। তাদের জমি নেই, নেই ঘর। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর ফারজিনা স্বপ্ন দেখে পুরস্কারের টাকায় হাওরপাড়ে ঘর বানানোর। শিশুটির স্বপ্নপূরণে কিছু জমি দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সেখানে ঘর করার জন্য অর্থও বরাদ্দ হয়। কিন্তু ছয় মাস হতে চললেও মাথা গোঁজার ঘর আর হয়নি। ঘরের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে ঘুরতে ঘুরতে অতিষ্ঠ ফারজিনার বাবা মো. সায়েম। ক্ষোভে-অভিমানে শেষ পর্যন্ত পুরো পরিবার নিয়ে এলাকা ছাড়লেন তিনি।
মো. সায়েমের মা সিলেটে থাকেন। তিনি শ্রমিকের কাজ করেন। আপাতত মায়ের কাছে উঠেছেন। পরিবার চালাতে যে কাজ পাবেন, সেটাই করার ইচ্ছে তাঁর।
ফারজিনার বাবা আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি অনেক করেছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর ফারজিনার কারণে অনেক সম্মান পেয়েছি, অনেক আশ্বাসও পেয়েছি। কিন্তু সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা দেখেছি, তাতে হতাশও হয়েছি।’
সুনামগঞ্জে না থেকে সিলেট কেন এমন প্রশ্ন করলে ফারজিনার বাবা বলেন, ‘ঘর না থাকলে থাকমু কই? ঘরের জন্য ঘুরতে ঘুরতে হয়রান। কী করমু, এলাকা না ছেড়ে তো কোনো উপায় নাই। আমাদের এলাকায় অন্যের জায়গায় থাকতে দেয় না, ভাড়াও দেয় না, তাই সিলেট চলে এসেছি। যাতে থাকার জায়গা হয়, আবার শ্রমিকের কাজও করতে পারি।
জানা যায়, সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীর সঙ্গে ফারজিনাসহ তার পরিবারের সবাই দেখা করেন। জেলা প্রশাসক তাদের মিষ্টি খাওয়ান। পরিবারের আর্থিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। ফারজিনার লেখাপড়ার জন্য ২০ হাজার টাকাও দেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদের একটি ঘর করে দেওয়ার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক। সেই সঙ্গে সব সময় তার পরিবারের খোঁজখবর রাখার জন্য তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন তিনি। সায়েম এরপর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ঘরের জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ডিসেম্বর মাসে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর মাধ্যমে ফারজিনার পরিবারকে একটি ঘর দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সময়ে ফারজিনার বাবা ও মায়ের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় ১০ লাখ টাকার একটি পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী বড়ছড়া মৌজায় ফারজিনার পরিবারকে ১৭ শতক জমি দেওয়া হয়। ওই জমিতে একটি ঘর করে দেওয়ার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ের অনুকূলে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। সাত মাস পার হয়ে গেলেও ঘর আর হয়নি। ফলে জমিটিও বেদখল অবস্থায় আছে। এ জন্য উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন সায়েম। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কার্যালয়ে গিয়ে কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিজন কুমার সিংহ বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমি বন্দোবস্ত দিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘরের বরাদ্দটি এসেছে সমাজসেবা কার্যালয়ের অনুকূলে। আমি এ জন্য জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালকের সঙ্গে দুবার কথা বলেছি। দ্রুত কাজটি করার অনুরোধ করেছি। কিন্তু কেন তারা এটি করছে না, সেটি বুঝতে পারছি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক সুচিত্রা সরকার বলেন, ‘আমরা উপজেলা কমিটির কাছে টাকা দিয়ে দিয়েছি। তিন দিন আগেও তাদের তাগাদা দিয়েছি দ্রুত ঘরটি করে দেওয়া জন্য। এটি হয়ে যাবে।’