রশি ধরে লাঠিতে ভর করে মসজিদে ছুটে যান দৃষ্টিহীন শতবর্ষী আব্দুর রহমান
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের বড়দেহা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান। বয়স ছাড়িয়েছে ১১৫ বছর। প্রায় ২০ বছর আগে দুর্ঘটনায় চোখ দুটি হারিয়েছেন তিনি। একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে দৃষ্টিহীন জীবনের দুঃসহ কষ্ট। তবুও আল্লাহর পথে অবিচল এই প্রবীণ। বাঁশ ধরে ও লাঠিতে ভর দিয়ে এবং রাস্তার পাশে টানানো রশিতে ধরে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ছুটে যান নিজের হাতে গড়া মসজিদে। আজান দেন নিজেই। নামাজও পড়ান তিনি। তার এমন দৃঢ়তা মুগ্ধ করে যে কাউকে।
আব্দুর রহমানের চলাচলের সুবিধার্থে তার বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় ২০০ মিটার রাস্তার পাশ দিয়ে বাঁশ ও রশি টেনে দেওয়া হয়েছে। এতে তিনি রশি ধরে অনায়াসে যেতে পারেন মসজিদে। নামাজের ওয়াক্ত শুরু হলে ওজু করে লাঠি হাতে বাড়ি থেকে বের হন মসজিদের উদ্দেশে। লাঠিতে ভর করে বাড়ি থেকে বের হয়েই রশি ধরে ধরে মূল সড়কে ওঠেন। এরপর লাঠির সাহায্যে রাস্তা পার হয়ে বাঁশ ধরে ধরে পৌঁছে যান মসজিদে।
এলাকাবাসী জানায়, প্রায় ২০ বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন আব্দুর রহমান মোল্লা। দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার পরও বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ২০১১ সালে হজ পালন করেন। এরপর গ্রামে নিজের পাঁচ শতক জমির ওপর তৈরি করেন একটি পাকা মসজিদ। সেই মসজিদের মুয়াজ্জিন ও ইমামের দায়িত্ব নিজেই পালন করে চলেছেন তিনি।
আব্দুর রহমানের দুই স্ত্রীর ঘরে ১৯ ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়। সন্তানেরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাদের কেউ শিক্ষক, কেউ কৃষি কর্মকর্তা, কেউ চিকিৎসক, কেউ আবার বিজিবি সদস্য, কেউবা ব্যবসায়ী, কেউ আবার নিজেদের জমি-জমা দেখাশোনা করেন।
আব্দুর রহমান মোল্লার ছেলে বরদেহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় বাবার চোখে সমস্যা দেখা দেয়। সেই থেকে ধীরে ধীরে দৃষ্টিহীন হয়ে যান বাবা। অনেক চিকিৎসা করেও ভালো করা সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে বাবাকে নিয়ে হজ পালন করি।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হজ পালন শেষে বাবার ইচ্ছায় নিজেদের জমিতে নিজেদের খরচে বাড়ি থেকে ২০০ মিটার দূরে মসজিদ তৈরি করি। সেখানে পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও পথচারী ও এলাকাবাসী নামাজ আদায় করে। বাবার চলাচলের সুবিধার জন্য তার পরামর্শে বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত বাঁশ ও রশি টেনে দিই। প্রথমে কিছুদিন আমরা বাঁশ ও রশি দেখিয়ে দিয়ে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে যেতাম। এখন বাবা একাই মসজিদে যেতে পারেন।’
আব্দুর রহমান মোল্লার ছোট ছেলে ইসরাফিল বলেন, ‘এ বয়সেও বাবা মসজিদে গিয়ে আজান দেন এবং নামাজ আদায় করেন। বাবাকে দেখে বাড়ির শিশুরাও মসজিদে যায় নামাজ পড়তে। বাড়ি থেকে মূল সড়ক পর্যন্ত যেতে তেমন সমস্যা না হলেও পাকা সড়ক পার হতে কিছুটা সমস্যা হয়। সড়কে অনেক যানবাহন চলাচল করে। এ কারণে কিছুটা অতঙ্কে থাকি আমরা। তবে আমাদের অনুরোধে সড়কে চলাচলকারী রিকশা-ভ্যানসহ হালকা যানবাহনের চালকরা মসজিদের সামনে সাবধানেই চলাচল করেন।’
শতবর্ষী আব্দুর রহমান বলেন, ‘নিজের জমি বিক্রি করে সেই অর্থে মসজিদটি নির্মাণ করেছি। আল্লাহ যাতে মসজিদটিকে কবুল করেন এবং পরিবারের সবাইকে হেদায়েত দান করেন, সেই দোয়া করি।’
দৃষ্টিহীন হয়েও তাকে মসজিদে গিয়ে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে দেখে গ্রামের অন্যরাও আগ্রহী হবেন বলেও প্রত্যাশার কথা জানান আব্দুর রহমান।