বেনজীর-আজিজদের অপকর্মের কারণেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা : রানা দাশগুপ্ত
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘আমাদের যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ তাদের কর্ণধারের দায়িত্ব যাঁরা পালন করছেন তাঁদের অপকর্মের কারণেই আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধজ্ঞা, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আজকের দিনে আমাদের মনে হয় এদের (ড. বেনজীর ও জেনারেল আজিজ) কারণেই হয়েছে।’
আজ শুক্রাবার (৭ জুন) সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জের সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক এলাকা পরিদর্শন ও ভুক্তভোগী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে গণমাধ্যমকে রানা দাশগুপ্ত এ কথা বলেন।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, র্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে ড. বেনজীর যে ভূমিকাটা পালন করছেন, এটা শুধু সরকারের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ণ করেনি, এটা গোটা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ণ করেছে। আমাদের যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ তাদের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করেছে। আজকে জনগণ উপলব্ধি করতে পারছে, এ জাতীয় কয়েকজন রাষ্ট্রীয় কর্ণধারের দায়িত্ব যাঁরা পালন করছেন তাঁদের অপকর্মের কারণেই আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। আজকের দিনে আমাদের মনে হয়, এদের (বেনজীর ও জেনারেল আজিজ) কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সময় আমরা বিষয়গুলো জানতাম না বলেই অনেক সময় মনে করেছি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে বেনজীর আহমেদ যে অন্যায়, অবিচার ও কুকর্মগুলো করেছেন এবং যেটি আপনারা ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়গুলো জানার পর আমরাও ভাবলাম, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ আই্নজীবী ঐক্য পরিষদ; আমরা সেখানে যাই এবং পুরো বিষয়টা দেখি। ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং (তথ্য অনুসন্ধান) যে কমিটিটা হয়েছে, এই কমিটি ইতোমধ্যে রিপোর্ট নেওয়া শুরু করেছে এবং রিপোর্টগুলো পেয়ে জাতীয় পর্যায়ে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিষয়টিকে উত্থাপন করতে চাই। সাংবাদিক বন্ধুরা, আপনারা যে বিশাল কাজটি করছেন আমরা আপনাদের সহযোগিতা ও সহায়তা করতে চাই।’
ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ উল্লেখ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমারা ভাবি, বাংলাদেশের ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের জায়গা জমি দখলের ঘটনা এটা নিত্যদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং এই জায়গা জমি দখলের ক্ষেত্রে প্রায় সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা রাষ্ট্রের প্রভাশালী ব্যক্তি। যখনই যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারা সেই সরকারের মদদপুষ্ট। তারা এই ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে সাধারণ নিরীহ ও শান্তিপূর্ণ নাগরিকের জীবনে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো যেটা ঘটছে, বেনজীর সেখানে একজন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।’
সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজের কথা উল্লেখ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘যদিও জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের জায়গা-জমি দখল বা জবর দখলের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আমাদের জানা নেই। কিন্তু র্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে ড. বেনজীর যে ভূমিকাটা পালন করছেন, এটা শুধু সরকারের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ণ করেনি, এটা গোটা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আজকে আমি পরিস্কারভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি আবদেন করতে চাই, এই এলাকাটি শতভাগ হিন্দু প্রধান এলাকা। যাদের শত শত বিঘা জমি জোর করে, হুমকি দিয়ে, নানা চক্রান্তমূলভাবে বেনজীর দখল করে নিয়েছেন। শুধু দখলই করেনি, আমরা লক্ষ করেছি, সরকারি রাস্তা বন্ধ করে গেট ও কাটা তারের বেড়া দিয়ে এমনভাবে চারদিকে বেষ্টনি করা হয়েছে, যাতে অন্য কেউ ওই জায়গায় প্রবেশ করতে না পারে। ওই দিকে (পার্কের ভিতরে) এলাকার সংখ্যালঘুদের জায়গা জমি আছে, ওগুলো তারা আর দেখাশোনা করতে পারছেন না। অথচ, এখানকার লোকজনের প্রধান জীবিকার উৎস হলো কৃষি। আজকে এই জীবিকার উৎস থেকে তারা বঞ্চিত হওয়ার ফলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি বিশাল অর্থনৈতিক সংকট নেমে এসেছে। আমি আজকে এখান থেকে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি আবেদন করতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এলাকাটি আপনারই। আপনি একবার এলাকায় আসুন, আপনি দেখে যান, কীভাবে এখানকার সংখ্যালঘুদের জায়গা জমি জবর দখল করেছেন বেনজীর আহমেদ। আমরা দাবি জানাই এবং আবেদনও জানাই, যাদের সম্পত্তিগুলো দখল করা হয়েছে, তাদের সম্পত্তিগুলো তাদের ফেরত দেওয়া হোক। এখন এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে। একই সঙ্গে বলতে চাই, এই এলাকার সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমও আসুক, জনগণ জানতে চায় তাদের এ অবস্থা কেন হলো।’
রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, ‘আমি আহ্বান জানাই তাঁরা একবার যাতে আসেন। এতে যারা ইতোমধ্যে সম্পদ হারিয়েছেন তারা অন্তত সান্ত্বনা পাবে। তাদেরও যে মূল কথা, সম্পত্তি ফেরত চাই, এই জায়গাটিতে প্রধানমন্ত্রী নিজে এসে পরিস্থিতি অবলোকন করে অবশ্যই বিবেচনা করবেন, এ আশা আমরা করতে পারি।’
রানা দাসগুপ্ত আরও বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি। তথ্য সংগ্রহ করার পর আমারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশি ও বিদেশি সাংবাদিক যারা আছেন, তাদের জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সম্যক পরিস্থিতি জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে চাই, আমরা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছেও তুলে ধরতে চাই। এই অর্থে কীভাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অন্তত সবাই একবার এসে দেখে যাক। আমরা প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এখানে যারা বিদেশি রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তাদের কাছেও আবেদন করি আপনার আসুন, আপনারা দেখে যান, এ এলাকার সংখ্যালঘুরা কোন পরিস্থিতিতে আছেন। কোন শঙ্কায় তারা আজকে অবস্থান করছেন। এর মধ্য দিয়ে গোটা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জনজীবনের যে সংকট, এই সংকটটিকে উপলব্ধি করা যাবে। এই বিষয়গুলো যদি গণমাধ্যমে প্রকাশ না পেত তাহেল এটা তো বাংলার মানুষ জানতে পারত না, আজকে পার্লামেন্টে এটা আলোচনার বিষয় হতে পারত না।
মামলা চলকালীন বেনজীরের বিদেশ যাওয়া বিষয়ে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমরা শুনেছি বেনজীর ৮০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। আমরা দেখছি, এই জাতীয় যারা রাষ্ট্রের কোনো না কোনো একটি সময় ব্যাংকে হোক, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে হোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রেই হোক, এমনকি আমাদের সেনা প্রধান যিনি ছিলেন জেনারেল আজিজ আজকে গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা শুনতে পাচ্ছি। কেউ আর দেশে নেই। অতএব আমরা মনে করি এই যে তারা একটি মামলা বা এ আলোচনা শুরু হওয়ার পরে দেশ থেকে তারা চলে গেল এবং দেশ ত্যাগ করতে পারল, এ ব্যাপারে সরকারেরও জবাবদিহিতা প্রয়োজন আছে। আমরা এ ব্যাপারেও সরকারের কাছে সুস্পষ্ট জবাবদিহিতা চাই।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সমালোচনা করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, বেনজীর ও আজিজ যা করেছেন সেটা ওনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে রাষ্ট্রের কোনো বিষয় না। এ বিষয়গুলোকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে চেপে রাখার কোনো বাস্তবতা নেই। অতএব আজকে তাদেরও উচিত, তারা বলুক এই মামলা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কী করে তারা এ দেশ থেকে চলে গেল। এবং বিচার এড়ানোর তারা চেষ্টা করছে।’
এ সময় বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকট তাপস কুমার পাল ও মণীন্দ্র কুমার নাথ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আইনজীবী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অনুপ কুমার সাহা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।