শায়েখ আসহাবুলের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী এনাম হাসপাতাল
ঢাকার মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) মেধাবী শিক্ষার্থী শায়েখ আসহাবুল ইয়ামিনের (২৪) স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে এনাম হাসপাতাল এলাকার আকাশ-বাতাস।
আজ বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে আসহাবুল ইয়ামিন পুলিশের রাবার বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে নিহত হন।
নিহত হওয়ার মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে আসহাবুল কোটা সংস্কারের পক্ষে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। সেটি ছিল পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও স্টান গ্রেনেড থেকে আত্মরক্ষায় করণীয় সম্পর্কে। ওই পোস্টের কিছুক্ষণ আগে আরেকটি পোস্ট দেন তিনি।
সাভারে পাকিজার সামনে আজ দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তিনি যে স্থানটিতে নিহত হন সেখানে পুলিশ- ছাত্রলীগের অ্যাকশনের একটি ভিডিও চিত্র শেয়ার করেন। তারপর নিজেই সেখানে প্রাণ হারান।
ইয়ামিন এমআইএসটির গণনাযন্ত্র বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে ইয়ামিন ছোট। বড় বোন শায়েখ আসহাবুল জান্নাত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বাবা মো. মহিউদ্দিন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা বর্তমানে ব্যবসায়ী।
ইয়ামিন ২০১৮ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি, ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অসাধারণ ফলাফল করে তাক লাগিয়ে দেন।
ইয়ামিন মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগে একটি পোস্ট দেন। সেখানে লেখা, ‘শুধু কোটা নয়; গোটা দেশটাই সংস্কার প্রয়োজন।’
তার ঠিক আগের পোস্টে ইয়ামিন লেখেন, ‘আমি মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (MIST)-তে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য যদি আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে হেনস্তা করে, হুমকি দেয় বা বহিষ্কার করে, সেক্ষেত্রে আমরা সম্মিলিতভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য সকল প্রকারের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করার ঘোষণা দিব। ইতোমধ্যে আমাদের হলে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের ১৭ জুলাই দিনগত রাতে অন্যায়ভাবে হল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছিল কর্তৃপক্ষ, যা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশাল বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একইসঙ্গে আমরা এখন থেকে এমআইএসটিতে সংঘটিত সব ধরনের অনুষ্ঠান, ক্লাব কার্যক্রম, খেলাধুলা ইত্যাদি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম Shykh Aash-Ha-Bul Yamin, লেভেল- ৪, গণনাযন্ত্র বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ MIST।’
প্রত্যক্ষর্শীরা জানায়, আজ দুপুরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অভিমুখে অগ্রসর হলে পাকিজা, রেডিও কলোনীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় লাঠিহাতে হেলমেটপরা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও যোগ দেয় পুলিশের সঙ্গে।
দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার বিপরীতে চলতে থাকে বৃষ্টির মতো পুলিশের রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা। এই সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় দেড় শতাধিক।
বেলা পৌনে ৩টার দিকে একে একে গুলিবিদ্ধদের নেওয়া হয় সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আহত শিক্ষার্থী, পথচারী ও উৎসক জনতার ভিড়ে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে দেখা যায় কর্তব্যরত চিকিৎসকদের।
এর পর পরই একটি অটোরিকশায় করে গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত ইয়ামিনকে এনাম মেডিকেল হাসপাতালে আনার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। তাঁর পকেটে থাকা এমআইএসটির পরিচয়পত্র পেয়ে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মিজারুল রেহান পাভেল ও ডা. হাসান মাহবুব ইয়ামিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অসংখ্য রাবার বুলেটে ঝাঁঝড়া হয়ে অধিক রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
খবর পেয়ে ছুটে আসেন হাসপাতালে ছুটে আসেন ইয়ামিনের পরিবার ও স্বজনরা। এ সময় তাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে সেখানকার বাতাস।
ইয়ামিনের মতো মেধাবী শিক্ষার্থীকে এভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রাণ দিতে হবে–এটা মেনে নিতে পারছে না অনেকেই।
প্লাটফর্ম এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব সাভার ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের জেনারেল সেক্রেটারি ব্যাংকার ফাহিম দাদ খান রূপক ফেসবুকে শোক জানিয়ে লিখেছেন, ‘সাঈখ আসাবুল ইয়ামিন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সিএসসির শিক্ষার্থী ছিল। আমি জানি না কীভাবে এই মৃত্যুর ভার সইবে তার পরিবার ও স্বজনরা। এভাবে তার মৃত্যু সত্যিই অকল্পনীয়।’
‘সাঈখ আসাবুল ইয়ামিনদের জন্মই কি এভাবে চলে যাওয়ার জন্য? আর কত মৃত্যু হলে থামবে এই তাণ্ডব’- সাঈখ আসাবুল ইয়ামিনের নিথর দেহের ছবি দিয়ে অনেকে এমন প্রশ্নই করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।