কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে যা হলো
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব মৃত্যু হয়েছে, তা সবার জন্যই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আজ মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের বেঞ্চে রিটের দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে আন্দোলনকারীদের ওপর তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশনা চাওয়ার রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট এ মন্তব্য করেন। আগামীকাল বুধবার তৃতীয় দিনের শুনানি শেষে আদেশের দিন ধার্য করা হয়।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার অনিক আর হক, অ্যাডভোকেট মানজুর আল মতিন প্রীতম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মো. মোরসেদ ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাছান চৌধুরী।
আজ বেলা ১১টায় এ শুনানিকে কেন্দ্র করে আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী, বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে আদালত কক্ষ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। শুনানির শুরুতে অনিক আর হক বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয় বছরের শিশু রিয়ার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতে পেশ করেন।
এ সময় আদালত বলেন, সংবিধান ও আইনে সব বিষয় লেখা আছে, কিন্তু আমরা কেউ সংবিধান, আইন মেনে চলছি না। এসব মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক। তখন আইনজীবী অনিক আর হক বলেন, নিঃসন্দেহে (দুঃখজনক)। একটা জীবন যখন চলে যায়, তখন কোনো পক্ষ থাকে না। আর এটা ছয় বছরের একটি শিশুর মৃত্যু!
তখন এই আইনজীবীকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, আমরা কোর্টে ইমোশনাল বিষয় অ্যাড্রেস করব না। আমরা খুব লজ্জিত।
পরে আইনি দিক তুলে ধরে আইনজীবী অনিক আর হক শুনানিতে বলেন, পুলিশকে যদি গুলি চালাতেই হয়, তবে পা লক্ষ্য করে গুলি করতে হবে। রাতে ডাকাত ধরার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে কেবল সরাসরি গুলি করতে পারবে।
হাইকোর্ট বলেন, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে পুলিশ কী আচরণ করবে, তা পিআরবিতে বলা আছে। অনিক আর হক বলেন, রামপুরায় বিটিভি-মেট্রোরেলে যখন আগুন লাগানো হয়েছে, তখন একটি গুলিও চলেনি। গুলি হয়েছে মিছিলে। যখন কোনো বিষয় এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে যায়, তখন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি করতে পারে।
হাইকোর্ট বলেন, এক্সট্রিম পর্যায়ের বিষয়টি তো কোশচেন অব ফ্যাক্ট। অনিক আর হক বলেন, আমাদের সাবমিশন, প্রথমেই যাতে লাইভ গুলি না চালানো হয়। আদালত বলেন, পুলিশ তো পরিস্থিতি অনুযায়ী রাবার বুলেট ছুড়তে পারে। না হলে মাইকে ঘোষণা দেবে—এরপর গুলি করতে বাধ্য হবে। কারফিউর মধ্যে তো গুলি হয়নি।
অনিক আর হক বলেন, কারফিউর মধ্যে কেউ তো বেরও হয়নি। তারা পিআরবি ফলো করুক। আমরা চাই না কোথাও পুলিশের ওপর আক্রমণ হোক। আমরা বলছি না পুলিশ তাদের কাজ করবে না। হাইকোর্ট বলেন, আমরা এমন কোনো কাজ করব না, যাতে জাতির ক্ষতি হতে পারে।
অনিক আর হক বলেন, জাতির ক্ষতির মধ্যে মানুষের জীবনও আছে। আমরা বলছি লাইভ (সরাসরি) গুলি যাতে না করা হয়। আগে রং দেওয়া পানি দেওয়া হতো, গরম পানি মারা হতো। এ সময় আদালত বলেন, আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত না, যাতে জাতির ক্ষতি হয়।
অনিক আর হক বলেন, জাতির ক্ষতি বলতে শুধুমাত্র কিছু ভবন, স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি বোঝালে হবে না। জীবনের ক্ষতিও জাতির ক্ষতি। আগে বিক্ষোভ দমন বা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গরম পানি, মরিচের গুঁড়া ব্যবহার করত। জবাবে আদালত বলেন, ‘টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ব্যবহার করা যেতে পারে। তার আগে মাইকিং করে সতর্ক করতে হবে। আমরা কেউই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি না। পুলিশ কখন আর্মি কল করতে পারে, সেটিও আইনে বলা আছে। পুলিশকে যে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, তার খবর ও ছবি খুব একটা প্রচারে আসেনি।’
এ সময় রিটকারী পক্ষে অপর আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘ছয় সমন্বয়ককে যে হেফাজতে রাখা হয়েছে, এটা তো স্বীকৃত। আইন কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে কাউকে এভাবে হেফাজতে রাখার সুযোগ নেই। আইনি ক্ষমতার বাইরে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। বলা হচ্ছে যে, তাঁদের (ছয় সমন্বয়ক) আত্মীয়-স্বজনরা দেখা করতে পারছেন। কিন্তু তাঁরা (ছয় সমন্বয়ক) কার সঙ্গে দেখা করতে চান বা চান না, সেটা জানার কোনো সুযোগ নেই। তার মানে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চলছে।’
আদালত সায় দিয়ে বলেন, ‘একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আটকাতে হবে। হয় রিমান্ডে নিতে হবে, নয় আদালতে তুলতে হবে।’
এরপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর। শুনানিতে তিনি ছয় সমন্বয়কের জীবন ঝুঁকি ও হুমকির কথা তুলে ধরেন। আর এ কারণেই ডিবি তাদের হেফাজতে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তখন আদালত বলেন, ‘তাদের যে মেরে ফেলবে এই কথাটা তাঁদেরই বলতে হবে। সে তো আশ্রয় চায়নি।’
এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী জবাবে বলেন, রিট আবেদনকারীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য এসেছেন। তারা একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। এখানে যারা এসেছেন (রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী) তারা সবাই এই কমিশনের সদস্য। তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ আছে। গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান রিট আবেদনকারী একজনের বাবা।
জাতিসংঘের একটি সনদ উদ্বৃত করে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। ওই সনদ অনুসারে অনুপেক্ষিত ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীরা গুলি চালাতে পারবে। কোনটা অনুপেক্ষিত পরিস্থিতি, সে সিদ্ধান্তও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই নিতে হবে। এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, আমরা আদালতের ভেতরে আছি। আইনের মধ্য থেকে কথা বলব। এমন কিছু বলব না, যাতে কেবল মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়।
আদালত তখন বলেন, বিষয়টি সব পক্ষেরই খেয়াল রাখা দরকার। এখন দেশে যে অবস্থা সে পরিস্থিতিতে ছয় সমন্বয়ককে পুলিশ আটকে রাখতে পারে কি না।
জবাবে আইন কর্মকর্তা মোরশেদ বলেন, দেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাকে কীভাবে রাখবে সে সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোটা নিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেখানে সর্বোচ্চ আদালত কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। আদালত আশা প্রকাশ করেছেন, যে তদন্ত কমিশন সরকার গঠন করেছে সেই কমিশন প্রত্যেকটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করবে। তা সত্ত্বেও তারা (রিট আবেদনকারী পক্ষকে উদ্দেশ করে) গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
সভা-সমাবেশের অধিকার নিয়ে এই আইন কর্মকর্তা বলেন, আইনি বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে সভা-সমাবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে বল প্রয়োগ করেছে, তার কোনো প্রমাণ তাদের (রিট আবেদনকারীদের) কাছে নেই।
এ সময় শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ আদালতকে বলেন, এ রিট আবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আগামীকাল শুনানি করবেন। তখন আদালত আগামীকাল বুধবার বলে এজলাস কক্ষ ছেড়ে যান।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরাসরি লাইভ রাউন্ড (তাজা গুলি) ব্যবহার না করার নির্দেশনা চেয়ে গত সোমবার (২৯ জুলাই) রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। তারা হলেন—আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন এবং আইনুন্নাহার সিদ্দিকা।
রিটে কথিত নিরাপত্তার নামে হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তির নির্দেশনাও চান দুই আবেদনকারী। আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিচালক, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানকে বিবাদী করা হয়েছে রিটে।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি তাজা গুলির ব্যবহার কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, জানতে বিবাদীদের প্রতি রুল জারির আরজি জানানো হয়েছে রিটে। সেইসঙ্গে কথিত নিরাপত্তার নামে হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তি দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রিটে সে মর্মেও রুল চাওয়া হয়।
গত সোমবার রিটে প্রথম দিন শুনানির পর রিটের আরজি সংশোধন করতে বলেন আদালত সে অনুযায়ী রুলের আরজি সংশোধন করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে আটকে রাখা হয়নি তা নিশ্চিত হতে তাদের আদালতের সামনে হাজির করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে এই মর্মেও রুল চাওয়া হয়।