সাবেক সংসদ সদস্য প্রিন্সসহ ১০৩ আ.লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
পাবনায় শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি করে দুই ছাত্র হত্যার ঘটনায় পাবনা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্সসহ ১০৩ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে। আজ রোববার (১১ আগস্ট) সদর উপজেলার চরবলরামপুর গ্রামের নিহত জাহিদুল ইসলামের (১৯) বাবা দুলাল উদ্দিন মাস্টার ও ব্রজনাথপুর বেতেপাড়া গ্রামের নিহত মাহবুব হাসান নিলয়ের (১৬) বাবা কালাম ড্রাইভার যৌথভাবে বাদী হয়ে এই মামলা করেন।
নিহত জাহিদুল পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রোনিক্স বিভাগের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র এবং নিলয় পাবনা শহরের ছিদ্দিক মোমোরিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র।
মামলার আসামিরা হলেন জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি রেজাউল রহিম লাল, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভাড়ারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খানসহ তাঁর তিন ভাই, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আ স ম আব্দুর রহিম পাকন, প্যানেল চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম সোহেল, পাবনা পৌরসভার মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান, পাবনা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল হাসান শাহিন, সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ মোশারোফ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগনেতা কামিল হোসেন প্রমুখ।
এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দদুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিনা উসকানিতে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খান, সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সসহ অন্যরা প্রকাশ্যে পিস্তল ও শর্টগান দিয়ে ছাত্রদের মিছিলে গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই জাহিদুল ইসলাম (১৯) ও মাহবুবুল হোসেন নিলয় (১৬) নিহত হয়। এ ছাড়া একই দিন পৃথক ঘটনায় ফাহিম হোসেন রাজ্জাক (১৭) নামের আরেক ছাত্রও মারা যায়।
সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজন নিহত হয়। শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করা ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাঈদু খান, প্রিন্স, কামিল হোসেন, কামরুল হাসান মিন্টু, রুহুল আমিনসহ সব স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর লাপাত্তা হয়েছেন।
সংসদ সদ্য গোলাম ফারুক প্রিন্সের গুলি করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাবনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি পিস্তল নিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়তে ছুড়তে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ধাওয়া করছেন। তাঁর পাশে অনেকের হাতে শর্টগান, লোহার রড, জিআই পাইপ ছিল। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিন্দার ঝড় উঠে।
এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু, জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিবলী সাদিক, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম পাকন, জেলা পরিষদের সদস্য নজরুল ইসলাম সোহেল, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল হাসান শাহীন, পৌরসভার মেয়র শরীফ প্রধান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন, আওয়ামী লীগনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে শর্টগান ও পিস্তল হাতে নিয়ে দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই জেলঅ আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। তারা ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার অনেক ঢাকায়ও অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। অনেকে পাবনাতেই আত্মগোপনে আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী জানান, আসলে এমন একটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে কখনো ভাবিনি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ৪১ সাল পর্যন্ত আমরা ক্ষমতায় থাকব। হঠাৎ নেত্রীর এমন পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। আমরা এখন পুরো এতিম। এতদিন যাদের কথামতো দল করেছি, দলের বিভিন্ন বিপদ-আপদে থেকেছি, আজকে পাবনার সেসব নেতা লাপাত্তা। সবার ফোন বন্ধ। কোথায় গেছেন আমাদের পাবনার নেতারা কেউ বলতে পারব না। আমরা এখন অভিভাবকহীন। বাড়ির বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছি। সেজন্য আজ কয়েকদিন হলো বাড়ির বাইরে যেতে পারছি না। বাড়িতে থেকেই এলাকার কিছু নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কিন্তু বেশির ভাগ নেতাকর্মীরও ফোন বন্ধ রয়েছে। তৃণমূলের গ্রামগঞ্জেরও হাজার হাজার নেতাকর্মী বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে এক দিন সুদিন আসবে।
পাবনা জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড জাকির হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পাবনায় শিক্ষার্থীদের মিছিলে অতর্কিত গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটা নৃশংসতা বলতে হবে। বিএনপির আমলেও সন্ত্রাসীদের দিয়ে গুলি করানো হয়েছে।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল হাসান শাহিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আমি ওই দিন মিছিল শেষ করে বাড়িতে এলে গুলিতে মারা যাওয়ার খবর পাই। অথচ আমাকেও আসামি করা হয়েছে।
জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রাফিউল ইসলাম রাফি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সেদিন যা ঘটেছে তা খুবই ঘৃণিত কাজ। আমি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। এখন একটু সুস্থ হয়েছি। আমরা তো নিরস্ত্র ছিলাম। আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পাবনার সমন্বয়ক ফাহাদ হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পাবনায় গত ৪ আগস্ট ছাত্র জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে অনেক নেতা মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ করেছে। গুলি করে যারা ছাত্র হত্যা করেছে তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মো. নাসিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ছাত্রদের শান্তিপুর্ণ মিছিলে যারা নির্বাচারে গুলি করে তারা কোনো সময় দেশপ্রেমিক নাগরিক নয়। তাদের সন্ত্রাসী বলতে হবে। তৃণমূলের কর্মীদের মাঠে নামাতে না পেরে নেতারা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করা ন্যক্কারজনক কাজ। এটা আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। গুলি করে এখন তারা পলাতক। এত সাহস তাহলে পালাল কেন। এদের ধরে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করতে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ব্যবহৃত ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এজন্য বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পাবনার সব থানার কার্যক্রম এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিকে হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করলে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেদিন আমিও ওখানে ডিউটিতে ছিলাম।