ডিএনএ টেস্টে হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ উত্তোলন, রাষ্ট্রীয় সম্মানে দাফনের দাবি মেয়ের
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও আলোচিত বিএনপিনেতা হারিছ চৌধুরীর ডিএনএ টেস্টে পরিচয় নিশ্চিত এবং রাষ্ট্রীয় সম্মানে দাফনের দাবিতে কবর থেকে তোলা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ‘মাহমুদুর রহমান’ পরিচয়ে সমাহিত দেহাবশেষ।
আজ বুধবার (১৬ অক্টোবর) সকালে সাভারের বিরুলিয়ার কমলাপুর জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদ্রাসা কবরস্থান থেকে দেহাবশেষ তোলা হয়।
এ সময় স্বজন, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, সিআইডি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরে সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। দুপুর ২টার দিকে নমুনা সংরক্ষণের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
দেহাবশেষ উত্তোলনে নেতৃত্ব দেন সাভার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রাসেল ইসলাম নুর।
আজ সকাল ৮টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিআইডি ও পুলিশ সদস্যরা মাদ্রাসার সামনে অবস্থান করছেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরীর পৌঁছানোর পর শুরু হয় দেহাবশেষ তোলার কাজ। মৃত্যুর এক হাজার ১৩৮ দিন পর আজ দুপুর সোয়া ১২টার দিকে দেহাবশেষ কবর থেকে তোলা হয়।
ওয়ান-ইলেভেনের পর আত্মগোপনে চলে যান হারিছ চৌধুরী। দীর্ঘ ১৪ বছর গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ‘মাহমুদুর রহমান’ পরিচয়ে বসবাস করতেন রাজধানীর পান্থপথে।
২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা যান হারিছ চৌধুরী।
পরে স্বজনদের পরামর্শে হারিছ চৌধুরীর মরদেহ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ‘মাহমুদুর রহমান’ পরিচয়েই দাফন করা হয়।
মরদেহ দাফনের সময় লন্ডন প্রবাসী মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী উপস্থিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে মৃত্যু সনদ নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। সৃষ্টি হয় ধুম্রজাল। এমন পরিস্থিতিতে বাবার প্রকৃত পরিচয় প্রমাণে ডিএনএ পরীক্ষা, মৃত্যু সনদ, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ থেকে নাম প্রত্যাহার, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দাফনের আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট করেন তিনি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মাহবুবুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিএনপিনেতা হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে ডিএনএ টেস্টের নির্দেশ দেন।
এই নির্দেশনা পেয়ে গত ৮ অক্টোবর ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ের বিচার শাখা থেকে দেহাবশেষ উত্তোলনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
দেহাবশেষ উত্তোলনের সময় উপস্থিত ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ জানান, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ভিন্ন পরিচয়ে এভাবে দাফন করাটা ছিল অবমাননাকর।
আদালতের নির্দেশনার আলোকে ডিএনএ টেস্ট প্রতিবেদন স্বজনদের সঙ্গে ম্যাচ করলে পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে দেহাবশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানোর মধ্য দিয়ে পুনরায় দাফন করা হবে।
জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আশিকুর রহমান কাশেমী বলেন, “‘২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘মাহমুদুর রহমান’ নামে মরদেহটি দাফন এখানে করা হয়। আমার নেতৃত্বে জানাজায় হাফেজ ও মাদ্রাসার ছাত্ররা অংশ নেয়। আমি নিজেই জানাজা পরিচালনা করি। আমাদের কাছে এই দেহাবশেষের পরিচয় ‘মাহমুদুর রহমান’। আমরাও চাই প্রকৃত পরিচয় বেরিয়ে আসুক। দেশবাসী জানুক তার পরিচয়, আমরাও জানি।”
হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী বলেন, ‘তিন বছর হলেও আমার বাবার মৃত্যু মীমাংসিত নয়। যদিও আমি জানি এই দেহাবশেষ আমার বাবার। তখনকার পরিস্থিতির কারণে আমরাই এই স্থানটিকে কবরের জন্য বেছে নিয়েছিলাম। তিনি একজন জাতীয় নেতা ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু আমরা মৃত্যু সনদ পাইনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয় প্রকৃতপক্ষে এই দেহাবশেষ কার? তাঁর প্রাপ্য সম্মান তাঁকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর চরিত্র হনন করেছে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। কোনো সন্তান চাইবে না, তার বাবার মৃত্যু নিয়ে এমন রহস্য থাকুক। এখন আমরা চাই, তিনি যাতে সম্মান পান। তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হোক। তিনি দেশের জন্য কাজ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাঁর সম্মান ও স্বীকৃতি ফেরত চাই।’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আসমাউল হুসনার নেতৃত্বে তিন সদস্যের ফরেনসিক দল ডিএনএ টেস্টের জন্য বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিএনএ এনালিস্ট আশরাফুল আলম জানান, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করছেন। তারা প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে আমাদের কাছে নমুনাগুলো দিলে আমরা দেহাবশেষ থেকে পাওয়া দাঁত ও হারের সঙ্গে স্বজনদের মুখের লালা এবং রক্তের ডিএনএ প্রফাইল করে পরিচয় নিশ্চিত করব।’