দুই সন্তানের স্মৃতিচারণায় ‘শতাব্দীর কণ্ঠস্বর তাজউদ্দীন আহমদ’
বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শনিবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে “শতাব্দীর কণ্ঠস্বর তাজউদ্দীন আহমদ : কন্যার চোখে, পুত্রের চোখে”শিরোনামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদ ও ছেলে সোহেল তাজ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আহমাদ মোস্তফা কামাল।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও রাজনীতি নিয়ে লেখা শারমিন আহমদের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’বইয়ের ‘স্টুডেন্ট এডিশন’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন শারমিন আহমদ ও সোহেল তাজ। উপস্থিত ছিলেন ঐতিহ্যের প্রধান নির্বাহী ও স্বত্বাধিকারী আরিফুর রহমান নাইম এবং কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল।
অনুষ্ঠানে মেয়ে ও ছেলে তাঁদের বাবা তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন। স্মৃতিচারণায় মেয়ে ও ছেলের আবেগঘন কথায় উঠে আসে পিতা, নেতা ও ব্যক্তি হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ কেমন ছিলেন—সেসবের অনেক অজানা দিক।
শারমিন আহমদ বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্কালে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তা উপলব্ধি করা যায় শত্রুপক্ষ পাকিস্তানের নেতৃপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও লেখকদের বক্তৃতা ও লেখায়। তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের অন্যতম নেপথ্য কারিগর তাজউদ্দীন আহমদ। আমরা মুজিবকে নিয়ে চিন্তিত না, আমাদের চিন্তা তাজউদ্দীনকে নিয়ে। শত্রুপক্ষের এইরকম স্বীকৃতি থেকেই দেশপ্রেমিক ও নিষ্ঠাবান তাজউদ্দীন আহমদের গুরুত্ব বুঝা যায়।
জাতির কাছে প্রশ্ন রেখে তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ বলেন, আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাধীনতা আন্দোলনের নির্দেশনার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু মানা করলেন; তবে তিনি কোথায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন? ২৫ মার্চ যখন ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আলোচনা করছিলেন, তখন আম্মা জিজ্ঞেস করছিল দেশের পরিস্থিতি কী হবে? তখন আব্বা বলেছিলেন আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবো এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিবো। সবাই বঙ্গবন্ধুর ওপর ভর করে আছে, কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি দিলেন না। স্বাধীনতার ভাগিদারও তিনি একা না। সর্বত্রই এটিকে এক ব্যক্তির যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিগত আমলেও বারবার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ যেন একটা দলের, একটা পরিবারের বিষয় শুধু। অথচ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা জনযুদ্ধ। কিন্তু জনযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস যেন নিগৃহীত হয়ে আসছিল দিনের পর দিন। আজ সময় এসেছে, জনযুদ্ধের ইতিহাস নতুন করে লেখার, বলার ও চর্চার। এই জনযুদ্ধে স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের সংগ্রামকে, তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে তুলে ধরার দাবি করেন শারমিন আহমদ। পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ইতিহাস নতুন করে অন্তর্ভুক্তির কথাও বলেন তিনি।
বাবাকে নিয়ে সোহেল তাজ বলেন, আমার বাবার একটা গুণাবলী ছিল ভালো জিনিস শেখা, আর সেটা প্রয়োজন হলে শত্রুর কাছ থেকে হলেও শেখা। নীতি ও আদর্শ যাই থাকুক উনি সবার কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার চেষ্টা করতেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন সক্রিয় সদস্য হিসেবে। তিনি যে মাপের নেতা ছিলেন সেটা আর কারো মধ্যে খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। তার নেতৃত্বের অনেক গুণাবলী ছিল, তিনি বিচক্ষণ ছিলেন। মানুষকে আপন করে নেওয়া, মানুষের সাথে কানেকশান করার দূরদর্শিতা তার মধ্যে অনেক বেশি ছিল। ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ডাক না হলেও একটা উদ্ধুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া ছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক। ৭ই মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত নেগোসিয়েশন চলছিল। বাবা ৩২ নম্বরে গেলেন টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করার জন্য। কিন্তু রেকর্ড করা হয়নি। বাবা চলে এলেন এবং বিষণ্ণ মনে সবকিছু ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল তুমি কেন যাওনি? তখন তিনি বলেছিলেন আমি পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্যই আন্ডারগ্রাউন্ডে যাইনি।
একাত্তরে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে যেমন তাজউদ্দীন আহমদ হাল ধরেছিলেন, তেমনি পঁচাত্তরের মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও বেগম জোহরা তাজউদ্দীন দলটির হাল ধরেছিলেন; আজকের আওয়ামী লীগের প্রতিকূল রাজনীতিতে সোহেল তাজ দলটির হাল ধরবেন কি-না সঞ্চালকের এই প্রশ্নে সোহেল তাজ বলেন, আওয়ামী লীগ যদি তাদের আত্মসমালোচনা করে, অতীতের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাজনীতিতে আসে এবং আমাকে প্রয়োজন মনে করে তাহলে বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখা হবে। সাথে সাথে সোহেল তাজ এই কথাও মনে করিয়ে দেন যে, ন্যায় ও ইনসাফের প্রশ্নে এবং গুড গভর্নেন্সের জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং এই ব্যাপারে তিনি কখনো আপস করবেন না। যেমনটা তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় করেননি, পদত্যাগ করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেন। সোহেল তাজ আরও বলেন, ক্ষমতার প্রতি আমার মোহ নাই, আমাদের পরিবার সবসময় গণমানুষের সেবায় বিশ্বাসী।
বিভিন্ন লিখিত ও অলিখিত সূত্রের উল্লেখ করে পুত্র সোহেল তাজ ও কন্যা শারমিন আহমদ স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ের তাজউদ্দীন আহমদের বহু অলিখিত অধ্যায় এই অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন; যা ইতোপূর্বে কোথাও ব্যক্ত করেননি তারা।
অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।