ভাঙল মেঘনার চরে তিন দিনব্যাপী লালপুরীর মেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে শেষ হলো তিন দিনব্যাপী লালপুরীর মেলা। গত ২৫ নভেম্বর শুরু হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) রাতে শেষ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা। শুরুর দিকে সাত দিনব্যাপী হলেও করোনার পর থেকে তিন দিনব্যাপী চলে এ মেলা।
মেঘনার বুকে ভেসে উঠা চর নুনেরটেক। চারপাশে মেঘনাঘেরা সোনারগাঁয়ের বারদী ইউনিয়নের সেই চরে মাওলানা নুরুল ইসলাম লালপুরীর ৫১তম ওরস। মানুষের কাছে যা পরিচিত ‘লালপুরীর মেলা’ নামে।
মেলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত শতশত দোকান। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেলায় বেড়েছিল মানুষের আনাগোনা। মেলার হৈহুল্লোড়ে চাপা পড়ে মাজার প্রাঙ্গণের আস্তানাগুলোতে শুরু হওয়া সামাগমের শব্দে। শখের হাঁড়ি, মাটির পুতুল, কাঠের ও বেতের ছোট ছোট আসবাব, প্লাস্টিকের খেলনা, জামা-কাপড়, গামছা, জুতা, তাবিজ, কবিরাজি ওষুধ কিংবা বিভিন্ন মুখরোচক খাবার ঘর।
মেলা প্রাঙ্গণের প্রবেশ মুখে বসেছিল সারি সারি খাবার দোকান। দোকানগুলোতে সদ্যভাজা পেঁয়াজু, ধোঁয়াউঠা জিলাপি, মোয়ামুড়কি, কদমা-বাতাসা, মুরলি, মিষ্টি গজা, মনাক্কা, নিমকি, তিলের খাঁজা, খই ও খড়ার মতো শৈশবের স্মৃতি বয়ে চলা মুখরোচক সব খাবারের পসরা।
এ ছাড়া লম্বা দোকানে সারি সারি সাজানো শতশত টমটম, চরকি গাড়ি আর কাগজের ফুল। শৈশব রাঙানো এসব ঐতিহ্যবাহী খেলনা তৈরির কারিগর মোহন আলী ও মো. বুলবুলসহ বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থেকে প্রায় ১৫ জন মিলে মেলায় এসেছেন। বুলবুল জানিয়েছেন, ২৭ বছর ধরে মেঘনা চরের এই মেলায় আসেন তিনি। এ বছর ভালোই কেনাবেচা হয়েছে।
চেঙ্গাকান্দী গ্রামের মো. জুয়েল রাজধানীর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে। জানাল, যখন থেকে বোঝতে শিখেছে তখন থেকেই মেলায় আসে। এই মেলা তার জীবনের সবচেয়ে স্মৃতিময় উৎসব। জুয়েল বলে, ‘মেলায় এসে শিশুকালের স্মৃতি মনে পড়ছে বারবার। তখন বাবা-মায়ের কাছে কত কিছুর আবদার করতাম। এখন নিজেই খেলনা কিনছি বাড়ির শিশুদের জন্য।’
একটি যুব সংগঠনের নেতা খাইরুল ইসলাম জানালেন, মেঘনার বুকে ভেসে উঠা চরের ছয়টি গ্রামে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসতি। মেলাটি এই চরাঞ্চলের অন্যতম বড় উৎসব। মেলা উপলক্ষে গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে অতিথি আসে। বাড়ি ফেরেন প্রবাসীরাও। যারা রাজনীতি করেন তাঁরাও আসেন।
চুয়াডাঙ্গা গ্রামের গৃহবধূ জিয়াসমিন জানান, তাঁরা প্রতি বছর মেলার জন্য অপেক্ষা করেন। মেলা ঘিরে গ্রামের মেয়েরা নাইওর আসে। কাজের খোঁজে দেশ-বিদেশে যাওয়া পুরুষরাও গ্রামে ফিরেন। ঘরে ঘরে ধুম পড়ে পিঠা পায়েস আর খাবার আয়োজনের। এমনকি মেলা উপলক্ষে নতুন জামা কাপড়ও কেনাকাটা হয়।
কুমিল্লার মানিকচর থেকে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা বৃদ্ধা মনোয়ারার জানান, প্রতি বছরই মেলার সময় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন তিনি। এটা এক ধরনের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মেলায় অংশ নিতে পাঁচ বছর পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাড়ি ফিরেছেন শিরিষ আলী, জসিম উদ্দিন, খাঁয়ের আলীর মতো প্রবাসীরা। মেলা শেষে ফের প্রবাসে ফিরবেন তাঁরা।
হাবিবুর বলেন, ‘মেলায় কেউ আসেন ধর্মীয় কারণে। কেউ কেনাকাটা করতে। আমরা প্রবাসীরা আসি সব বন্ধু স্বজনকে একসঙ্গে দেখার আশায়। এই মেলা আমাদের চরাঞ্চলের উৎসব। উৎসবে বাড়ি ফেরাই নিয়ম।
মেলায় মাজার প্রাঙ্গণ থেকে বহূদূর পর্যন্ত অস্থায়ী আস্তানাগুলোতে দূর দূরান্ত থেকে আসা ভক্ত দর্শনার্থীর ভিড় ছিল প্রতিদিনই।
নুরুল ইসলাম লালপুরীর বড় ছেলে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী জানান, তাঁর বাবার মৃত্যু দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৯ অগ্রহায়ণ থেকে ১৬ অগ্রহায়ণ পর্যন্ত সাতদিন উরস চলে। উরস উপলক্ষে বসে মেলা। হয় ওয়াজ নসিহত, শ্যামা গান আর মুর্শীদি গানের আসর। কিন্তু করোনা মহামারির পর থেকে তিন দিনব্যাপী হয় এই মেলা আয়োজন।