শেখ হাসিনার পলায়নের ৪ মাস : চলছে ষড়যন্ত্র, হচ্ছে প্রতিহত
আজ ৫ ডিসেম্বর। চার মাস আগের এই দিনে লাখো-কোটি জনতা নেমে এসেছিল রাজপথে। সেদিন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ওঠা কণ্ঠধ্বনিতে কম্পিত হয়েছিল রাজধানীর অলিগলিও। জনতার গণঅভ্যুত্থানে গণভবনের বিলাসী জীবন ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৫ বছরের দুঃশাসনে বাংলাদেশকে বিকিয়ে দেওয়া স্বৈরাচার। এরপর মন খুলে কথা বলার স্বাদ নিচ্ছেন দেশের নাগরিক। যদিও এই চার মাসে থেমে থাকেনি হাসিনা ও তার দোসররা, দেশকে অস্থির করতে একের পর এক ষড়যন্ত্রে মেতে আছেন তারা। এরসঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় বেশকিছু গণমাধ্যমও। এমনকি, জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে সেদেশে বাংলাদেশের সহকারি হাইকমিশনেও চলেছে হামলা।
নানা আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে মইন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দিনের কাঁধে ভর করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে মসনদে বসেন শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই খুলে ফেলেন মুখোশ। শুরু করেন বিরোধীদল ও মত দমন। এতে ব্যবহার করেন বিচার বিভাগকে। একইসঙ্গে রাজপথের আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে বল প্রয়োগ, মামলা, হামলা, গুম, হত্যার পথ বেছে নেন তিনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে গদি টিকিয়ে রাখেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে দিনের ভোট করেন রাতে। প্রশাসনের সব স্তরকে ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি ও মরা ব্যক্তির ভোটে ক্ষমতায় এলেও ২০২৪ সালের নির্বাচন খ্যাতি পায় ‘ডামি নির্বাচন’ নামে।
এভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবস্থান টিকিয়ে রাখা শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন একগুঁয়েমি, বেপরোয়া, অহঙ্কারী; হয়ে উঠেন হিংস্র ‘ওয়ানম্যান আর্মি’। এই অহঙ্কারের আগুনে পুড়ে অবমূল্যায়িত হন দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতারাও।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের পর শেহাসিনার বেপরোয়া একগুঁয়েমিতাই তার জন্য হয়ে ওঠে কাল। সাত মাস পূর্তির আগেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি।
ভারত ছাড়া আশ্রয় মেলেনি কোথাও
এক সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে।’ এর আগেপরে তার ভারতপ্রীতি নিয়ে ছিল আলোচনা, সমালোচনা, অভিযোগও। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ ভারতেই আশ্রয় নেওয়ার পর এটি ফের সামনে আসে। পরে জানা যায়, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দাবি, এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অধিকাংশতেই উপেক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থ। এভাবেই তিনি সেখানে থেকে গেছেন। যদিও যুক্তরাজ্যে যেতে চেয়েছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর চাউর হয়। তবে, সেখানের তথ্য বলছে, দেশটি তাঁকে নিতে রাজি হয়নি। পরে দুবাইয়ের নামও আসে তালিকায়। বিভিন্নসূত্রের তথ্য, আরব আমিরাতের এই রাজ্যটিও শেখ হাসিনাকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
পলানোর পরপরই ‘দাবির ষড়যন্ত্র’
শেখ হাসিনা পালানের পর পরই গা ঢাকা দেন তাঁর সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এর কিছুক্ষণের মধ্যে থানা ছাড়ে সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যাসহ গত সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুন-অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ জমে পাহাড় হয়ে ওঠে। তাদের মনের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে পুলিশের ওপর। ফলে আতঙ্কিত প্রায় সব পুলিশ সদস্য গিয়ে অবস্থান নেন পুলিশ লাইনসগুলোতে। এরপর তারাও তোলে দাবি।
একদিকে পুলিশকে মাঠে ফেরাতে সরকার যখন ব্যস্ত, তখন বিক্ষোভ শুরু করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। হাসিনা ভারতে পালানোর তিন দিনের মাথায়, অর্থাৎ ৮ আগস্ট রাতে শপথ নেন অন্তর্বতী সরকারের ১৩ উপদেষ্টা। তার আগেই রাজপথে দাবি নিয়ে আসে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বাড়িঘরে হামলার অভিযোগে শাহবাগে অবস্থান নেয় তারা। তারা এসব ঘটনার বিচার ও নিজেদের নিরাপত্তার দাবির পাশাপাশি সংসদে সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ আসন বরাদ্দেরও দাবি জানায়।
এরপর নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধে চট্টগ্রাম নগরের নিউমার্কেট মোড়ে অবস্থিত স্বাধীনতা স্তম্ভে জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগ তুলে ইসকন চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক চন্দন কুমার ধর প্রকাশ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ (৩৮) ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়ায়।
জুডিশিয়াল প্রোপাগান্ডা!
১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় ওবায়দুল হাসান হঠাৎই ফুল কোর্ট ডাকলে তোপের মুখে পড়েন। পরে সুপ্রিম কোর্টে আন্দোলন শুরু হলে তিনিসহ পদত্যাগ করেন ছয় বিচারপতি।
এর আগে সরকার যখন গঠন হয়নি, তখন রাষ্ট্রের প্রহরায় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ছিলেন শিক্ষার্থীরা। এমন এক সময় ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবি তোলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীরা। আসিফ মাহমুদ ৭ আগস্ট তার ফেসবুক আইডিতে লেখেন, ‘বিচার বিভাগের ফ্যাসিবাদ বিলোপ করতে হবে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিচার বিভাগে এখনও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার শরিক বিচারপতিরা বিচরণ করছেন। আমরা শুনতে পেলাম, অভ্যুত্থানের আগে আমাদের যেভাবে আদালতের নামে টালবাহানা করা হতো, ঠিক একই কায়দায় অভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্র-জনতার সরকার ব্যহত করার প্রচেষ্টা চলমান।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আমরা অচিরেই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সক্রিয় শরিক প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারপতিদের অপসারণ দাবি করছি।’ তিনি ৮ আগস্ট সকালের মধ্যে বিচারপতিদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ প্রত্যাশা করেছিলেন।
এমন দাবির পর ৮ আগস্ট সরকার গঠিত হলেও ‘জুডিশিয়াল ক্যু’র পরিকল্পনায় মেতে ওঠেন ওবায়দুল হাসান। এরপর তিনি ১০ তারিখ ফুল কোর্ট ডাকেন।
আনসারকাণ্ড
১১ আগস্ট সাধারণ আনসারদের চাকরি স্থায়ী করার দাবি ওঠে। যদিও সচিবালয় ঘেরাও করলে বেরিয়ে আসে এর পেছনের গল্প। ২৫ আগস্ট সেখানে অবস্থান নেন আনসার সদস্য অনেকে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবিগুলো বিবেচনা করা হবে বলে জানালেও এদিন কতিপয় আনসারের পোশাক পরা অনেকে সচিবালয় অবরোধ করেন। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিলে এবং সেনাবাহিনী অবস্থান নিলে সচিবালয় এলাকা ছাড়া হন তারা।
এই আনসার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তির নাম কাদের। জানা যায়, তিনি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ষাটঘর তেওতা (বিলপাড়া) এলাকায় তার বাবার বাড়ি এবং তেওতা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। কাদের ঢাকার হযরত শাহ জালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনসারের পিসি হিসেবে কর্মরত।
এদিকে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়া আনসারদের নেতৃত্ব দিয়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন কাদের। সচিবালয়ের ভেতরে বক্তব্য দেওয়া ওই ব্যক্তি যে আনসার সদস্য কাদের, সেটি স্থানীয় ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও প্রতিবেশী সফিউদ্দিন বিশ্বাস নিশ্চিত করেছেন।
পোশাক কারখানা শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলা
৫ আগস্টের পর সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের বেশিরভাগ পোশাক কারখানা খোলার পর বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকরা। এতে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস খাতে বাড়তে থাকে অস্থিরতা। অশান্ত হয়ে পড়ে শিল্পাঞ্চল। বন্ধ হয়ে যায় অনেক কারখানা। সরকারের মধ্যস্থতায় প্রায় মাসব্যাপী আন্দোলনের পর মুজুরি বৃদ্ধি এবং বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ‘ইনক্রিমেন্ট’ দেওয়াসহ ১৮টি দাবি মেনে নেয় মালিকপক্ষ। এরপর কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে এ খাতে। যদিও সেই আন্দোলন থামেনি। থেমে থেমে চলছে, উঠছে নানা দাবি। অনেকের দাবি, এই আন্দোলনের পেছনেও ছিল বেশ কিছু ষড়যন্ত্র। নেতৃত্বদানকারীদের যেসব ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে দেখা যায়, অনেক যুবলীগ ও ছাত্রলীগনেতা এর নেপথ্যে কাজ করেছে।
অটোরিকশা ও পায়েচালিত রিকশাচালক নিয়ে উত্তপ্ততা
২৬ আগস্ট সকালে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করে পায়েচলিত রিকশাচালকরা। সেদিন থেকে শুরু হয় অটোরিকশা ও পায়েচালিত রিকশাচালকদের মধ্যে বিরোধ। সেটি গত মাসেও নতুন করে বড় আকারে বিদ্বেষ ছাড়ায়। তারা নেমে আসেন রাজধানীর সড়কে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা জারি হওয়ার পর ২০ নভেম্বর দুপুরে তারা এই বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন রিকশাচালকরা। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েন।
ভারতে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ
কয়েক দিন ধরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। গত কয়েকদিনে এমন ঘটনা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফেনীর সীমান্তবর্তী পরশুরামের বিলোনিয়া স্থলবন্দরের ভারত অংশে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। সনাতনী হিন্দু সমাজের ব্যানারে কিছু ভারতীয় ওই বিক্ষোভ করেন। এ ঘটনায় গতকাল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এর আগে ২৮ নভেম্বর বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ নামের একটি সংগঠন কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে সহিংস বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আর ২ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশে শান্তিসেনা পাঠাতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আরজি জানান।
আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে হামলা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠনের সমর্থকেরা এ হামলা চালান। এদিন মুম্বাইয়ের বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের কাছাকাছি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আয়োজনে কয়েক শত লোক বিক্ষোভ করেছেন। হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি হলো ভিএইচপির সহযোগী সংগঠন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগরতলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কোনো অবস্থাতেই লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং দেশের (ভারতের) অন্যান্য স্থানে তাদের উপ ও সহকারী হাইকমিশনের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তবে আগরতলার হামলার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত উল্লেখ করে নিন্দা ও কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামলার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। এ ঘটনা কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন।
প্রোপাগান্ডায় ভারতের ‘দায়িত্বশীল’ মিডিয়াও
বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের গণমাধ্যমে অপপ্রচার (প্রোপাগান্ডা) চলছেই। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউবের মতো সোশ্যাল প্লাটফর্মের পাশাপাশি ‘রিপাবলিক বাংলা’র মতো কথিত গণমাধ্যমে অপপ্রচার চলেছিল। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই অপপ্রচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে অন্য গণমাধ্যমগুলোও। এমনকি ভারতের যেসব গণমাধ্যমকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘দায়িত্বশীল’ মনে করা হতো, তাদেরই এ ধরনের ভুল সংবাদ প্রচারে নেমে যেতে দেখা গেছে।
ভুল সংবাদ প্রচারের সবশেষ ঘটনাটি ঘটেছে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবীকে নিয়ে। ইসকন কলকাতার মুখপাত্র রাধারমণ দাস গত ২ ডিসেম্বর তার এক্স অ্যাকাউন্টে একটি পোস্টে দাবি করেন, চিন্ময় দাসের আইনজীবী রমেন রায়ের ওপর হামলা হয়েছে। পোস্টটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে আহত একজনের একটি ছবিও জুড়ে দেওয়া হয়। তার সেই পোস্ট মুহূর্তেই ভারতীয় গণমাধ্যম লুফে নেয়। এটির ওপর ভিত্তি করেই প্রচার হতে থাকে ‘সংবাদ’। ভুয়া এসব সংবাদে প্রচার হতে থাকে, ‘মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) আদালতে আসার কথা ছিল তার। কিন্তু তার আগেই রমেন রায়ের বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে এবং তাকে নৃশংসভাবে মারধর করা হয়েছে। রাধারমণের এক্স আইডির ওপর ভিত্তি করে এই ভুল সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর পাশাপাশি জি নিউজ, এবিপি লাইভ, দ্য ওয়াল যেমন ছিল, তেমনি ছিল টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইন্ডিয়া টুডের মতো প্রতিষ্ঠানও প্রচার করেছে।
ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার ও ফ্যাক্টওয়াচ এই খবরটি যাচাই করে দেখেছে, রমেন রায় নামে চিন্ময় দাসের কোনো আইনজীবীই নেই। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ওকালতনামা অনুসারে, তার আইনজীবী হিসেবে মামলাটিতে লড়ছেন শুভাশিস শর্মা।ফ্যাক্টওয়াচের যাচাইয়ে সংবাদটি ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ভারতীয় মিডিয়ার দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ফ্যাক্টওয়াচ। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী রমেন রায়ের ওপর হামলার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয়। এই নামে চট্টগ্রামে কোনো আইনজীবী নেই। ’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির তালিকা খুঁজেও এমন কোনো আইনজীবীর নাম পাওয়া যায়নি। আর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ওকালতনামা থেকে দেখা যায়, তার আইনজীবী হিসেবে মামলাটিতে লড়ছেন শুভাশিস শর্মা।
রিউমর স্ক্যানারের তথ্যও বলছে, তাদের অনুসন্ধানের তথ্য জানিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছে, ছড়ানো ছবির আহত ব্যক্তি তথা রমেন রায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী নন। যে আহত রমেন রায়ের ছবি ছড়িয়েছে, তিনি আইনজীবী হলেও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৫ নভেম্বর শাহবাগে চিন্ময়কে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কর্মসূচিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় রমেন রায় আহত হন। তবে তার বাড়ি ভাঙচুরের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের প্রতিনিধি গৌরাঙ্গ দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যম বিষয়টি মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করছে। রমেন রায় গত ২৫ নভেম্বর শাহবাগে আহত হয়েছেন। আহত রমেন রায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী নন।
পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের অনুষ্ঠানকে বাংলাদেশে ভাঙচুরের বলে প্রচার
ভারতের গণমাধ্যমে অপপ্রচারের ধারাবাহিকতায় গত ২ ডিসেম্বর আরটি-ইন্ডিয়ার ভেরিফায়েড এক্স আইডি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট দেওয়া হয়। যেখানে ক্যাপশনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির আক্রান্ত। এটিকে হামলাকারীদের দেবীর মূর্তি ভাঙার ফুটেজ বলা হচ্ছে। ’
একই ফুটেজ সেখানকার আরও কিছু গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্মে বাংলাদেশে মন্দিরে আক্রমণ দাবিতে প্রচার হয়।
অথচ রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ভিডিওটি ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার সুলতানপুরে আয়োজিত কালী পুজোর প্রতিমা প্রাক-বিসর্জনের মুহূর্তের।
শেখ হাসিনার সুরে সুর মেলায় ভারতের শীর্ষ গণমাধ্যমও
নভেম্বরের শুরুতে ‘ফাঁস হয়’ বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার অডিও ক্লিপ। তাতে শহীদ নূর হোসেন দিবসকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্রের কথাবার্তা ছিল। সেখানে যে কথা ছিল, তার সত্যতা যেন ফুটে ওঠে ভারতীয় শীর্ষ গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে। কারণ, ওই অডিওতে শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ীই ট্রাম্পের ছবি সংবলিত ফেস্টুনসহ কয়েকজন আটক বলে দাবি করেছে এই গণমাধ্যমটি।
ইন্ডিয়া টুডের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করায় বাংলাদেশে তাঁর সমর্থকদের বিজয় মিছিলে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং ফেস্টুন-ব্যানার জব্দ করা হয়েছে।
ফাঁস হওয়া অডিওতে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তাঁর ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পরিবর্তে মিছিলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি দিয়ে বানানো ফেস্টুন রাখতে হবে। সেখান হবে হামলা হলে সেই হামলার ছবি তুলতে হবে। এর জন্য আগে থেকেই সেট করে রাখতে হবে ক্যামেরা পারসনকে। এরপর হামলার ছবি আমেরিকায় পাঠিয়ে বলা হবে, ট্রাম্পের সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এভাবে বাস্তবায়ন করা হবে ষড়যন্ত্র।
ইন্ডিয়া টুডের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডেনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশে তাঁর সমর্থকরা বিজয় মিছিল করতে চাইলে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বাধা দেয়। কারণ হিসেবে তারা বলছে, মার্কিন নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছিলেন।
ইন্ডিয়া টুডের দাবি, তাদের কাছে এ জাতীয় ভিডিও পৌঁছেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু ব্যানার জব্দ করেছে। সেখানে ট্রাম্প, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ নূর হোসেনের ছবি সংবলিত ফেসটুন আছে। ট্রাম্পের ছবি সংবলিত ফেস্টুনে লেখা আছে, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প, বাংলাদেশে থেকে ভালোবাসা জানাই।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ গতকাল রাতে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে আটক করে। আটক ব্যক্তিদের কোনো রাজনৈতিক সংযোগ নেই এবং তাঁরা সাধারণ নাগরিক।
চাকরিতে আবেদনের বয়স বৃদ্ধির আলোচনার মধ্যে রাজপথে দাবি
সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি নিয়ে যখন সরকারও সোচ্চার, ঠিক সেই মুহূর্তে ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে জড়ো হন কিছু শিক্ষার্থী। এটি জনসাধারণেরও নজর কাড়ে। যদিও প্রশাসন খুব সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
চাকরি স্থায়ীকরণসহ দুই দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকার পতনের পর তারা হয়ে ওঠেন আরও বেশি কঠোর। শুরুতে কর্মবিরতি পালনে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে বিদ্যুৎ পরিচালনসেবা বন্ধ করে পালন করেন ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি। দিনটি ছিল ১৭ অক্টোবর। এদিন সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে আন্দোলন চালিয়ে যান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ঘটনায় একাধিক মামলা হয়। বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আন্দোলন চলাকালে কুমিল্লার চান্দিনার পল্লীবিদ্যুৎ কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৮ অক্টোবর থেকে স্থগিত হয় শাটডাউন কর্মসূচি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে হয় মামলাও।
ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বহাল রাখার দাবি
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। যদিও পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে এলাকায় ফিরতে চান। তবে, এর আগে ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়াম্যান-মেম্বারদের অপসারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, পুরোনো শাসকের সঙ্গে সম্পর্কিত কাউকে না রাখার যে দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সে প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত। পুরো স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্ন করার একটা প্রক্রিয়া। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
যদিও অপসারিতদের অনেকেই নিজেদের স্বপদ ফিরে পাওয়ার দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করেন। বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপিও দেওয়া হয় অনেকস্থানে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দাবি, তৃণমূলে নির্বাচিত এসব জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করা হলে গ্রাম আদালত, জন্ম ও মৃত্যু সনদ, নাগরিকত্ব, ওয়ারিশান সনদ দেওয়ার মতো বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম ব্যহত হবে। ঢালাওভাবে সবাইকে বরখাস্ত করা ঠিক হবে না। এ দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে সারা দেশ বৃহত্তর কর্মসূচি পালন করা হবে।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিকভাবে ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগের কথা বললেও সাড়ে ৬৯ হাজার চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সংরক্ষিত সদস্যের বিকল্প সরকারি কর্মকর্তা না পাওয়ায় বিপাকে পড়ে মন্ত্রণালয়। সব ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে ৫৪ হাজারের মতো সরকারি কর্মকর্তা প্রয়োজন বলে জানা যায়। পরে হাসান আরিফের দেওয়া তথ্য বলছে, সাড়ে তিনশোর মতো ইউপিতে দায়িত্বশীল কেউ ছিলেন না। সেখানে প্রশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করার কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। বাতিল করলে গ্রাম পর্যায়ে সেবাপ্রাপ্তিতে ধাক্কা লাগবে। কেননা, একটি গ্রাম নিয়েও ওয়ার্ড গঠিত। সেজন্য ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিয়ে গ্রামপর্যায়ে সেবা পৌঁছে দেওয়ায় ব্যাঘাত হোক সেটি চায় না সরকার।