১৭৮ দেশ ভ্রমণ করে রেকর্ড গড়লেন নাজমুন নাহার সোহাগী
লাল সবুজের পতাকা নিয়ে প্রথম বিশ্বজয়ী পরিব্রাজক এবং বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে ১৭৮টি দেশ ভ্রমণের অনন্য রেকর্ড গড়েছেন বাংলাদেশের নাজমুন নাহার সোহাগী। বিশ্ব ভ্রমণই তাঁর নেশা। পৃথিবীর কোনায় কোনায় রেখেছেন নিজের পায়ের স্পর্শ ও স্বাক্ষর। উড়িয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা।
সর্বশেষ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র পাপুয়া নিউগিনি পরিভ্রমণের মাধ্যমে ১৭৮টি দেশ ভ্রমণের রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে কথা বলেন এনটিভির সঙ্গে। তুলে ধরেন নিজের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ও ঘুরে বেড়ানোর গল্প।
নাজমুন নাহার সোহাগী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সর্বশেষ এই অভিযাত্রায় গত তিন মাসে আমি ভ্রমণ করেছি ওশেনিয়া মহাদেশের দেশ ফিজি, টোঙ্গা ভানুয়াতু, সালমান আইল্যান্ড ও পাপুয়া নিউগিনি।
ভ্রমণের উৎসাহ কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে নাজমুন নাহার সোহাগী বলেন, বিশ্ব ভ্রমণের জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসাহ যুগিয়েছেন আমার বাবা, দাদা ও বই। দাদা ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আরব ভূখণ্ডের নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। কিশোরী মন সেই থেকেই উড়ুক্কু। ২০০০ সাল। ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য ডাক পাই। গিয়ে দেখি আমিসহ ৮০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন সেখানে। তাদের এক একজনকে দেখেই এক একটি দেশ ভ্রমণেই ভুত চেপে বসে।
সবশেষ কয়েকটি দেশের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে নাজমুন নাহার সোহাগী বলেন, তবে ভ্রমণটা যেমন আনন্দের তেমনি কষ্টসাধ্য। আর বিশ্ব ভ্রমণটা তো আরো কঠিন। পাসপোর্ট, ভিসা, দুর্গম পথঘাট খাবার-দাবার সংস্কৃতি; সবকিছুর সাথে খাপ খাইয়ে চলাটা একটা চ্যালেঞ্জের। তারপরও সেই প্রত্যয়েই ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি সারা পৃথিবীতে। দুচোখ ভরে দেখেছি এই বিশ্বকে। নিবিড়ভাবে মিশে গেছি মানুষ আর প্রকৃতির সাথে।’
আফগানিস্তান ভ্রমণটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জের জানিয়ে সোহাগী বলেন, ‘সেখানে তালেবান শাসন। একেতো আমি একাকী নারী পর্যটক। আমি ওদের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বোরকা পড়ে নিলাম। ইমিগ্রেশনে ওরা আমার এই বেশভূষা দেখে বেজায় খুশি। বললো, তোমাকে ধন্যবাদ তুমি আমাদের মূল্যবোধকে সম্মান করেছ বলে।’
‘প্রকৃতপক্ষে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা খুব জরুরি। আপনি যেখানেই যান না কেন সেখানকার মানুষদের প্রতি সম্মান তাদের মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোটা খুবই জরুরি’ বলেন সোহাগী।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন, সাহস, অধ্যবসায় ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি আমাকে অভিজ্ঞতায় অনন্য উচ্চতায় নিয়ে এসেছে জানিয়ে ভ্রমণপিয়াসী নাজমুন নাহার সোহাগী বলেন, ‘নিজের দেশের পতাকাকে তুলে ধরি সবার আগে। তারপর অচেনা জায়গায় অজানা মানুষদের কাছে তুলে ধরি শান্তি, ঐক্য ও পরিবেশ রক্ষার বার্তা।’
আজ নিজেকে গর্বিত বলে মনে হয় এই ভেবে যে, অসংখ্য নারী আমাকে অনুসরণ করেন। নানা বাধা আর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে স্বপ্নপূরণের পথে অনেক নারীকে অনুপ্রাণিত করতে পারছি, এটাও আমার জন্য অনেক আনন্দের।
ভ্রমণসঙ্গী ও বাজেট প্রসঙ্গে নাজমুন নাহার সোহাগী বলেন, ভ্রমণ সঙ্গীর কথা কী বলবো! বিশ্বকে জানতে জানতেই জীবনের এতটা সময় একাকী পাড়ি দিলাম। এখনো সাতপাকে বাঁধা পড়িনি। বিয়ে যে করবো না এমনটা নয়। তবে মনের মতো সঙ্গী পেলে অবশ্যই বেছে নেব তেমন একজনকে।
‘আর যদি বলতে চান ভ্রমণসঙ্গীর কথা তাহলে বলবো, মাকে নিয়ে ভ্রমণ করেছি পৃথিবীর ১৪টি দেশ। আমি যেভাবে থেকেছি মা আমার সঙ্গে সেভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। অবশেষে মার একটি কথা আমার কানে আজও বাজে। ১৪টি দেশ ভ্রমণ করে আমার জীবনে যা কিছু অর্জন, তার সাথে বাকি জীবনে কোন কিছুর তুলনা করা যায় না। আমি ধন্য।’
সোহাগী আরও বলেন, ‘আর বাজেটের কথা বলতে গেলে প্রথমে আপনাকে মনে রাখতে হবে, একটি দেশে প্রবেশ করার পর তার সীমানায় আর কোন কোন দেশ আছে, সড়কপথে কত সহজে ও সাশ্রয়ে সেসব দেশ ভ্রমণ করা যায়; সে বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। আরেকটি বিষয় হলো, আমি সবসময় এমন সব জায়গা পছন্দ করি; যেখানে খুব কম খরচে স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপদে থাকা যায়।’
বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার গা ছমছমে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে নাজমুন নাহার সোহাগী জানান, দুর্গম পথ পেরিয়ে তাঁর স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে অভিযাত্রায় বরাবরই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিটি দেশের তাপমাত্রা, আবহাওয়া এমনকি খাবার সব কিছুতেই মোকাবিলা করতে হয়েছে কঠিন পরিস্থিতি। অনেক দেশে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণের সময় মধ্যরাতে গিনি কোনাক্রির জঙ্গলে আটকা পড়ে প্রায় সারারাত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক আদিবাসী বাসায় বাঁচার জন্য আশ্রয় নিতে হয়েছে। গুয়াতেমালা ভ্রমণের সময় গুলির মুখোমুখি, ইথিওপিয়া ভ্রমণের সময় আদিবাসীদের সাথে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে থাকতে হয়েছে। কোস্টারিকায় ব্রাসিলিতো নদীর মাঝে আটকা পড়ে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছি। উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডা যাওয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় জঙ্গলে আটকা পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মৌরিতানিয়ার সাহারা মরুভূমির মরুর ঝড়ে আটকা পড়ে ধারালো বস্তুর আঘাতে চোখে মুখে রক্তাক্ত হয়েছি। এভাবে পৃথিবীর পথে পথে নানা বৈরী প্রতিকূল পরিস্থিতি থামাতে পারেনি আমার দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। দেশকে হৃদয়ে ধারণ করে আর পৃথিবীকে আপন করে পৃথিবীর মাঝেই ছুটে চলেছি অবিরাম।’
ভ্রমণের দুঃসহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে সোহাগী বলেন, ‘নানা জায়গায় দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকে। এর মাঝেই সকল প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে দেখেছি পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্যকে। আর সেই অসাধারণ অভিজ্ঞতাই ছড়িয়ে দিয়েছি তরুণ প্রজন্মের মাঝে। বিশ্বের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মোটিভেশনাল স্পিকার হিসাবে। বিশ্ব ভ্রমণের অভিযাত্রার কারণে বিশ্বের নানা দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে থেকে পেয়েছি সম্মাননা ও সংবর্ধনা।’
অর্জনের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও ৫৫টির মতো অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা। ১০০তম দেশ ভ্রমণের সময় জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর দিয়েছেন ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি। এছাড়া পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ব্রেভ গার্ল উপাধি। একাকী বিশ্ব ভ্রমণের সময় বিশ্ব শান্তির বার্তা বহন করায় ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যে ‘পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন বাংলাদেশি হিসেবে সেই অর্জন ছিল অনেক গর্বের। মিখাইল গর্ভাচেভ, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা এই সম্মাননার অধিকারী হয়েছেন।
এছাড়া পিস রানার অ্যাওয়ার্ড (যুক্তরাষ্ট্র), স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড (যুক্তরাজ্য), উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (যুক্তরাজ্য), সাকসেস অ্যাওয়ার্ড (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), উইমেন এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড (কোলকাতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়), রোটএশিয়া লেজেন্ডস অ্যাওয়ার্ড, অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা, বিদ্রোহী নারী সম্মাননা, মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড (যুক্তরাষ্ট্র), পাওয়ার উইমেন এওয়ার্ড (সাউথ সুদান), গেম চেঞ্জার অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড, মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল উইমেন অব বাংলাদেশ, গ্লোব অ্যাওয়ার্ড (যুক্তরাষ্ট্র), অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল সম্মাননা, জনটা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, তিন বাংলা সম্মাননা ও রেড ক্রিসেন্ট মোটিভেশনাল অ্যাওয়ার্ড, ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড, উইমেন ওয়ারিয়র সম্মাননা পেয়েছেন সোহাগী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন শেষ করে নাজমুন নাহার সোহাগী সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘এশিয়ান স্টাডিজ’ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তে ‘হিউমান রাইটস এন্ড এশিয়া’ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
নাজমুন নাহার সোহাগী জানান, আমাদের লাল–সবুজের পতাকা বহন করে বিশ্বভ্রমণের ইতিহাসে একটি রেকর্ড গড়েছি। দেশকে তুলে ধরেছি ভিনদেশিদের মাঝে। জীবনের এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।