বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক কত, কী কাজে যুক্ত ভারতীয়রা?
বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা অবস্থান করছেন। এদের অনেকে যুক্ত আছেন নানা পেশাতেও। তাদের সংখ্যা কম না, লাখের ওপরে—বলছে বছর খানেক আগের এক তথ্য। তেমনটিই জানিয়েছে জার্মান ভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে। ৪৪টিরও বেশি দেশের অনেক নাগরিক এদেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এসব বিদেশিদের অনেকেই এখন অবৈধ। তাদেরকে অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ করেছে সরকার।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের দেওয়া ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের তথ্যে ডয়চে ভেলে জানায়, বাংলাদেশে বৈধভাবে বিদেশি নাগরিক কতজন অবস্থান করছেন তার একটি হিসাব দিয়েছিল। তাদের সেই রিপোর্ট অনুসারে সে সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা ছিল এক লাখ সাত হাজার ১৬৭জন। এর মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংক্রান্ত ভিসায় এসেছিলেন ১০ হাজার ৪৮৫ জন, চাকরি ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, স্টাডি ভিসায় ছয় হাজার ৮২৭ ও ট্যুরিস্ট ভিসায় ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন। ওই সময় সবচেয়ে বেশি ছিল ভারতীয় নাগরিক ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে চীনের নাগরিক ১১ হাজার ৪০৪ জন। এ ছাড়া বাংলাদেশে ইউরোপ, অ্যামেরিকা ও আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক ছিলেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২০ সালে তাদের এক জরিপে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে দুই লাখ ৫০ হাজার। এই সংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিটেন্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে ন্যূনতম প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়।
টিআইবি গবেষণায় দেখেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৪টিরও বেশি দেশের নাগরিক বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশসমূহ হচ্ছে—ভারত, চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। তাদের তথ্য অনুযায়ী এদের মধ্যে ভারতের নাগরিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি কর্মী কাজ করছে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইলসংশ্লিষ্ট খাতসমূহে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসা সেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি কাজ করছেন।
গত ২৪ জুন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে জানান, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বছরে আয়ের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত নেই। তবে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশিরা তাদের আয় থেকে ১৩০.৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। তার মধ্যে শীর্ষ তিন দেশ—ভারত ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার, চীন ১৪.৫৬ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কা ১২.৭১ মিলিয়ন ডলার নিয়েছে।
‘অবৈধ বিদেশি খেদাও আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিবেচনায় বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ লাখ বিদেশি অবৈধভাবে আছেন। যাদের ৮০ ভাগ ভারতীয়। তবে, আমাদের এই তথ্য কোনো গবেষণার ফল নয়। আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য, উইকিপিডিয়া ও গবেষণার তথ্য থেকে এটা অনুমান করছি। তাই প্রকৃত অবৈধ বিদেশির সংখ্যা জানতে গত এপ্রিলে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলাম। হাইকোর্ট অবৈধ বিদেশির সংখ্যা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে রুল দিয়েছেন। জানুয়ারি মাসে শুনানি হতে পারে।’
পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, ‘আসলে পার্সপোর্ট নেই বা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে এরকম অবৈধ বিদেশি বাংলাদেশে থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম। যাদের অবৈধ বলা হচ্ছে তারা মূলত ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আর তারা ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে বছরের পর বছর এখানে চাকরি ব্যবসা করছেন। আফ্রিকার কিছু দেশের নাগরিক আছেন যারা এখানে অবস্থান করে প্রতারক চক্র গড়ে তুলেছেন। তারা বার বার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আয়কর ফাঁকি দিয়ে এখানে কাজ করে নিজ দেশে অর্থপাচারের জন্যই ওই বিদেশিরা টুরিস্ট ভিসায় এসে এখানে কাজ করছেন। আর এটা সবাই জানলেও দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
খান সাঈদ হাসান বলেন, ‘বিদেশি নাগরিকদের একটি অংশ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। কারণ, ধরা পড়লে জরিমানার অঙ্ক খুবই কম, মাত্র ৩০ হাজার টাকা। আবার অনেকে ভিসার শ্রেণি পরিবর্তন করেও বেশি দিন অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছেন।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা ওয়েবসাইট বিডিজবসডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘বাংলাদেশে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা আছে যেখানে বিদেশিরা কাজ করেন। তাদের আসলে আন্তর্জাতিকভাবে হায়ার করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে পরামর্শক আছেন। তারা আসলে অধিকাংশই বৈধভাবে কাজ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক কারখানা, বায়িং হাউজ, সেবা খাত, হেটেল, হাসপাতাল এইস প্রতিষ্ঠানে অনেক ভারতীয় কাজ করেন। তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বছরের পর বছর এখানে কাজ করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওসব খাতে আসলে আমাদের দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে সত্য কিন্তু তাদের বাইরে থেকে আনার আইনি কাঠামো আছে। সেটা মানা হচ্ছে না। এটা ক্ষতিকর। এর কারণ হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আনে তারাও যেমন কর ফাঁকি দেয়। তেমনি যারা আসেন তারাও ট্যাক্স দেন না।’ ‘আসলে আমাদের সক্ষমতা গড়ে তোলা উচিত। আমরা সেদিকে নজর না দিয়ে দক্ষ জনশক্তির জন্য এখানো বিদেশনির্ভর’, বলেন তিনি।
এদিকে, ভিনদেশি নাগরিকদের যারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদেরকে অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টর বিশেষ সহকারী মো. খোদা বাখস চৌধুরীর সই করা এক ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’তে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, অনেক ভিনদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। যে সব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বা কর্মরত আছেন, তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ করা হলো।
‘এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্যও অনুরোধ করা হলো’ উল্লেখ করে ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অন্যথায় অবৈধভাবে অবস্থানকারী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে এটা ভালো। এইদেশে কাজ করতে হলে বৈধভাবে কাজ করতে হবে। কেনো দেশেই তো অবৈধভাবে কাজ করার সুযোগ নেই।’