নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, কাউকে সাপোর্টের জন্য আসিনি : সিইসি
আওয়ামী লীগের দখলে থাকা দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে সংসদ নির্বাচন হয়েছে তিনটি। এর কোনোটি ‘দিনের ভোট রাতে হয়েছে’, আবার কোনোটি হয়েছে ‘ডামি নির্বাচন’—এমনটাই দাবি অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষের। যার খেসারত দিতে হয়েছে দলটির সভাপতি একরোখা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে পালিয়ে ভারতে নিতে হয়েছে আশ্রয়। আন্দোলনে হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে এখন মানুষ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগ করছেন। এমন অবস্থায় তারা পছন্দের প্রার্থীকে দিতে চান ভোট। আর সেজন্য চান সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা। এমন এক মুহূর্তে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এ এম এম নাসির উদ্দীন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে তার কার্যালয়ে গত সোমবার (৯ ডিসেম্বর) বিকেলে এনটিভি অনলাইনের একান্ত সাক্ষাৎকারে নির্বাচন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মাসুদ রায়হান পলাশ।
এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। যখন পুরো জাতি আপনাদের দিকে নজর রাখছে। শুরুতে আপনার অনুভুতি জানতে চাই।
সিইসি : শেষ বয়সে আল্লাহ তায়ালা আমাকে একটা বিরাট সুযোগ দিয়েছেন। আমি এটাকে দেশের সেবা করার একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছি।
রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
সিইসি : সরকার কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। নির্বাচন করতে গেলে নির্বাচন কমিশনেরও কিছু সংস্কারের দরকার হবে। অ্যাসেনসিয়াল রিফর্ম, যেগুলো নির্বাচন করার জন্য জরুরি; ওই ম্যানডেটরি সংস্কার না করে নির্বাচনে যেতে পারব না। সেগুলো করে আমরা নির্বাচনের…। তবে, নির্বাচনের জন্য আমাদের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। যখনই নির্বাচনের দরকার হবে, যেন আমরা নির্বাচন করতে পারি।
নির্বাচনের আগে ইসি কিছু কাজ করে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসহ নতুন পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধন। এগুলোর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই।
সিইসি : আইন অনুযায়ী খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ২ জানুযারি। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হবে ২ মার্চ। আমরা দেখছি, অনেক রোহিঙ্গা ভোটার হয়ে গেছে। অনেক ফেইক ভোটার হয়ে গেছে। এগুলোর বিষয়ে আমাদের অবস্থান খুব কঠোর। এসব ব্যাপারে তদন্তের কাজ শুরু করেছি আমরা। তারপর আন্দোলনে যারা এতো রক্ত দিল, সেই ইয়াংগার জেনারেশনকে ভোটার করতে হবে। বাদ পড়াগুলো আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইনপুট করছি। হালনাগাদ মার্চে শুরু হবে, বিষয়টা তেমন নয়। ইতিমধ্যে এ কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। আর ফেইক ভোটারগুলো আমরা আইডেন্টিফাই করছি। নীলফামারী সদর উপজেলা থেকেই ভোটার হয়েছে ১৯ জন রোহিঙ্গা।
গত তিনটা নির্বাচন এদেশের মানুষ দেখেছে। তারা নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছে। শুধু যদি অফিসে বসে ভোটার তালিকা করি, দেখবেন অনেক ভোটার বাদ পড়ে যাবে। সেজন্য, আমরা চাই, মানুষের ভেতর একটা উৎসাহ তৈরি হোক।
বিগত সময়ে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে ১৩০ আসনের সীমানা বদল করা হয়েছে বলে একটি অভিযোগ রয়েছে। আসন বিন্যাসের কাজ আমরা শুরু করেছি। একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য যে যে প্রস্তুতি দরকার, সব ব্যাপারে কাজ চলছে।
নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রসঙ্গে আপনাদের ভাবনা কী?
সিইসি : আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের সুপারিশ পেলে তখন দেখা যাবে। সংস্কার কমিশনে কেউ কেউ দাবি করেছেন, কোনো নিবন্ধন লাগবে না। সংস্কার কমিশন থেকে যদি এমন সুপারিশ আসে, কোনো নিবন্ধনই লাগবে না এবং নির্বাচন কমিশন যদি তা গ্রহণ করে; তাহলে তো এ প্রসঙ্গই থাকল না। ফলে, সুপারিশ পাওয়ার পর এসব বিষয় চূড়ান্ত করা হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং জামায়াতের আমির বারবার বলছেন, বাংলাদেশ নিয়ে অনেক চক্রান্ত হচ্ছে। নির্বাচনে যদি সময়ক্ষেপণ করা হয়, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। আপনার ভাবনা জানতে চাই।
সিইসি : আমরা সময়ক্ষেপণ করছি না। করব না। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যখন সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিবে, তখন আমরা নির্বাচন করতে পারব। নির্বাচন করার জন্য আমরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখব, এবং সেটা চলছে।
আগে সংসদ ভাঙলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান থাকত। এখন সেই সংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। তাহলে আপনি কীভাবে বুঝবেন, শিডিউল দেওয়ার এখন উপযুক্ত সময়?
সিইসি : অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিলে বা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে আমরা যেকোনো সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকব। নির্বাচন করতে গেলে কেবল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করলে তো হবে না। সাংবিধানিক সংস্কার আছে। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সরাসরি হবে নাকি অন্যভাবে হবে। লোকাল গভর্নমেন্টসহ আরও কিছু রিলেটেড সংস্কারের বিষয় রয়েছে। মূল কথা হলো, উনারা (সরকার) যখনই নির্বাচন করতে চান, আমরা প্রস্তুত থাকব।
বিগত সময়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ছিল না। এই আস্থার সংকট এবার কাটবে বলে আপনি মনে করেন?
সিইসি : বিগত সময় আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। তার মানে, তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের এই প্রতিশ্রুতি বস্তবায়নে কাজ করব। আমরাও তাই, জাতিকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে চাই। ফলে, ভালো ভোট করতে আমরা একে অপরের সহযোগী। সুতরাং, আস্থার সংকট তো থাকার কথা না।
যেসব সংস্কার নির্বাচিত সরকার বা পলিটিক্যাল পার্টি ছাড়া হবে না, সেগুলোর ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সিইসি : এগুলো আমার মাথাব্যথার বিষয় না। যারা রিফর্ম কমিশনগুলো গঠন করেছে, তারা বলেছে যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তারা ফয়সালা করবে। যেগুলো সম্মিলিতভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, সেগুলো ইসি অ্যাকসেপ্ট করবে। এ ধরনের আলোচনা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছি। সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো আগে আমরা দেখি। তারপর আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলব।
গত তিনটা সংসদ নির্বাচন অনেক বিতর্কিত। এ নির্বাচনে যারা জড়িত ছিল, তারা এখনও মাঠ প্রশাসনে রয়েছে। তাদের শাস্তির আওতায় আনার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা।
সিইসি : আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বদিউল আলম মজুমদাররা এসব কথা উঠিয়েছেন। আগে দেখি, তাদের সুপারিশে কী আসে। তার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
প্রতি সংসদ নির্বাচনের আগে পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে একটি সংলাপের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। আপনারা সংলাপ করবেন কিনা?
সিইসি : আমরা প্রয়োজনে অবশ্যই সংলাপ করব। কারণ, উনারাই তো আমাদের মেইন প্লেয়ার। আমরা মাঠটা তৈরি করে দেব। রুলস অব দ্যা গেম মেনে তারা খেলবে। উনাদের বাদ দিয়ে তো কোনোকিছু চিন্তা করা যায় না। উনাদের সঙ্গে আলোচনা করতেই হবে।
আপনি যেহেতু একজন আমলা ছিলেন। এই প্রশাসনের ভেতরেও তো একটা গুণগত পরিবর্তন দরকার আছে। যেমন রিটার্নিং অফিসার বরাবরই ডিসিরা হয়। এটা নিয়ে ইসির কর্মকর্তাদের অনেক অভিযোগ। সেক্ষেত্রে নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা?
সিইসি : নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আগে আসুক, তার আগে আমি কিছুই বলতে পারব না। এই যে আপনি যেগুলো বলছেন, সংস্কার কমিশনও এগুলো আলোচনায় রাখছে। সুপারিশটা আগে আসুক। আমি কাউকে সাপোর্ট করার জন্য, প্রমোট করার জন্য আসিনি। একটা ফ্রি, ফেয়ার এবং ক্রেডিবল ইলেকশন করার জন্য যা যা করা দরকার, তা তা করব ইনশাল্লাহ। জনগণ বিগত সময়ে ভোট দিতে পারেনি। আমরা জণগণের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চাই।
মানুষকে নির্বাচনমূখী করা, এটা বিগ চ্যালেঞ্জ। এই যে ঘরে ঘরে যাওয়া (ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য), কেন যাওয়া? আমরা ঘরে ঘরে গেলে ওনারা বুঝবেন যে ভোটের একটা আমেজ শুরু হয়েছে।
ভোটের সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরা ভোট দিতে পারেন না। তারাও যেন ভোট দিতে পারেন, সেই সুযোগ তৈরির ব্যাপারে কোনো চিন্তা রয়েছে কিনা?
সিইসি : যারা ভোটের সঙ্গে রিলেটেড থাকবে, তাদের একটা ভোটের ব্যবস্থা কীভাবে করা যেতে পারে, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। শুধু তাই নয়, আমরা প্রবাসীদের ভোটার হিসেবে ইনক্লুড করার জন্য আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, আমরা করছি।
আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমনা দলগুলো যদি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার সুযোগ থাকবে কিনা?
সিইসি : এসব হাইপোথেটিক্যাল ব্যাপার, ওই সময় এবং পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন বলা যাবে।
সংসদ নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে, আপনার ধারণা জানতে চাই।
সিইসি : আমরা ধারণা করতে চাই না। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে করতে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়….। এ মুহূর্তে প্রেডিক্ট করা মুশকিল।
এনটিভি অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সিইসি : আপনাকেও ধন্যবাদ।