কোভিডের মতো প্রাণঘাতী নয় এইচএমপিভি : অধ্যাপক তাহমিনা
কোভিড-১৯ (করোনা) মহামারির পর বিশ্বেজুড়ে যে ভাইরাসটি আলোচনায় এসেছে তা হলো হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি)। নতুন করে আলোচনায় এলেও ভাইরাসটি বেশ পুরোনো। চলতি জানুয়ারির শুরুতে চীনে এর সংক্রমণ ধরা পড়লে নতুন করে পুরো বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে। এরই মধ্যে জাপান, মালয়েশিয়া ও ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাসটি।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ধাঁচের এই ভাইরাসে এরই মধ্যে বাংলাদেশেও আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। তবে ভাইরাসটি নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকার কথা জানিয়েছেন আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন। এনটিভি অনলাইনের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম।
এনটিভি অনলাইন : এইচএমপিভি ভাইরাস কী?
অধ্যাপক তাহমিনা : ভাইরাস হলো অতি ক্ষুদ্র সংক্রামক জীবাণু, যা শুধু একটি জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। উদ্ভিদ, প্রাণী থেকে শুরু করে ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়াসহ সব জীবজগতকে আক্রান্ত করে ভাইরাস। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রেই ভাইরাস পাওয়া যায়।
২০০১ সালে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) আবিষ্কার হয়। তখন আমাদের দেশেও এটি নিয়ে গবেষণা হয়েছিল। তবে আবিষ্কারেরও ৬০ বছর আগে থেকে ভাইরাসটি মানবজগতে রয়েছে। ফলে কোভিডের মতো নতুন ধরনের ভাইরাস এইচএমপিভি নয়।
এনটিভি অনলাইন : এর লক্ষণ বা উপসর্গ কী?
অধ্যাপক তাহমিনা : জ্বর, নাক বন্ধ, কাশি বা শ্বাসকষ্টের মতো সাধারণ ঠান্ডাজনিত সমস্যা দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে এই ভাইরাসের সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। অনেক সময় সংক্রমণের তীব্রতা ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা বা কানে ইনফেকশনের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
শ্বাসতন্ত্রে ছড়ায় এমন অন্যান্য ভাইরাসের মতোই এটি। অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরনের ভাইরাসের আক্রমণের মতোই, যার উপসর্গ হিসেবে জ্বর-সর্দি-কাশি-ঠান্ডা হয়ে থাকে।
এনটিভি অনলাইন : এইচএমপিভি কীভাবে ছড়াতে পারে?
অধ্যাপক তাহমিনা : এইচএমপিভি অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের মতো ছড়ায়। এটি সাধারণত সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সৃষ্ট বায়ুকণা থেকে ছড়ায়। এছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তির জীবাণু হাঁচি-কাশির কারণে বা জীবাণুযুক্ত হাত দিয়ে স্পর্শ করলে অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। এইচএমপিভিতে আক্রান্ত কারও কাছে গিয়ে তার কাপড় বা ব্যবহার্য কোনো জিনিসি ধরে নাকে-মুখে-চোখে হাত দিলে এইচএমপিভি শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়ে দেহে প্রবেশ করে। আক্রান্ত হওয়ার ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। গড়ে ৫ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা যায়।
এনটিভি অনলাইন : এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কারা?
অধ্যাপক তাহমিনা : করোনাভাইরাসের মতো এই ভাইরাসেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। বিশেষ করে আগে যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল, তারা নতুন এই ভাইরাসের আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকবেন। বিশেষ করে কিডনি, হাইপ্রেসারসহ যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা আছে। তবে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। করোনার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই, সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
এনটিভি অনলাইন : এইচএমপিভির চিকিৎসা কি?
অধ্যাপক তাহমিনা : এটি অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরনের ভাইরাসের আক্রমণের মতোই, যার উপসর্গ হিসেবে জ্বর-সর্দি-কাশি-ঠান্ডা হয়ে থাকে। এতে সংক্রমিত হলে চিকিৎসার জন্য আলাদা কোনো ওষুধও নেই। তাই এর চিকিৎসাও তেমনই। প্যারাসিটামল বা ঠান্ডা জ্বরের প্রাথমিক চিকিৎসাই বলা যায়। তবে পরিস্থিতি বুঝে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ থাকবে।
এনটিভি অনলাইন : এইচএমপিভির টিকা নিয়ে কোনো আপডেট আছে কী?
অধ্যাপক তাহমিনা : এইচএমপিভি ২০০১ সালে আবিষ্কার হলেও এর সংক্রমণ প্রতিরোধে কোনো টিকা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। পৃথিবীতে লাখ লাখ এমন ভাইরাস রয়েছে, যার কোনো টিকা বা ওষুধ নেই। তাই বলে সেই ভাইরাসের সংক্রমণে মানুষ মারা যাচ্ছেন, এমন কিন্তু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংক্রমণ নিজে থেকে সেরে যায়।
এনটিভি অনলাইন : এটি প্রতিরোধে কী কী সতর্কতা নেওয়া উচিত?
অধ্যাপক তাহমিনা : এই ভাইরাসের সংক্রমণ কোভিডের মতো প্রাণঘাতী নয়। তবে শিশু ও খুব বয়স্কদের সাবধানে থাকা জরুরি। ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সংক্রমণ যেন না ছড়ায় সে বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। হাঁচি-কাশির সময় ব্যবহৃত রুমাল বা তোয়ালে পরিষ্কার রাখতে হবে। এছাড়া ঠান্ডা ও জ্বরের জন্য সাধারণ ওষুধ সেবন করলেই হবে।
যেকোনো সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র উপায় পরিচ্ছন্নতা। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শিশু, বয়স্কসহ সবাইকে পরিচ্ছন্নতায় জোর দিতে হবে। যেকোনো কিছু খাওয়ার আগে হাত পরিষ্কার করতে হবে। অযথা ভয় পাবেন না, কিন্তু সতর্ক থাকতে ভুলবেন না। পরিচ্ছন্নতাই সংক্রমণ রুখতে পারে।
যেসব বাচ্চার অ্যালার্জিজনিত হাঁচি, সর্দি লাগা বা হাঁপানির প্রবণতা আছে, তাদের সাবধানে রাখুন। বাড়ির বাইরে বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করতে বলুন।
এই ভাইরাসও ড্রপলেট, অর্থাৎ হাঁচি- কাশি মাধ্যমে ছড়ায়। এই ব্যাপারে সাবধানে থাকতে হবে। সর্দিকাশি হলে তার কাছাকাছি যেতে নেই।
এনটিভি অনলাইন : কোন কোন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এইচএমপিভি?
অধ্যাপক তাহমিনা : এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাব প্রথমে শুরু হয় চীনে। এরপর জাপান, মালয়েশিয়াসহ বর্তমানে ভারতেও এ ভাইরাস আক্রান্তের কথা শোনা যায়। এর আগে ২০২৩ সালে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে এইচএমপিভি শনাক্ত হয়েছিল।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়তে পারে?
অধ্যাপক তাহমিনা : এটা নতুন কোনো ভাইরাস নয়। এমনকি এ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগের কোনো কারণও নেই। কোভিড-১৯ একেবারে ভিন্ন ও নতুন আবহের ভাইরাস হওয়ায় এর প্রাদুর্ভাব বা মহামারির রেশ এতটা বিস্তর হয়েছিল।