নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি ৭১ শতাংশ : ডা. তাহমিনা শিরীন
শীত মানেই খেজুরের রস খাওয়ার মৌসুম। খেজুরের কাঁচা রস খেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন— এটি এখন কমবেশি সবাই জানেন। তবে প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের ভয়াবহতা দেশের সাধারণ নাগরিকদের অনেকেরই অজানা। কাঁচা খেজুরের রসে শুধু নিপাহ ভাইরাসই নয়, আরও অনেক ভয়াবহ ভাইরাস থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন। এনটিভি অনলাইনের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, কাঁচা খেজুরের রস পানে শুধু নিপাহ ভাইরাসই নয়, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ভাইরাসেও আক্রান্ত হতে পারেন। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুকি প্রায় ৭১ শতাংশ। আক্রান্ত বাকি ২০ শতাংশ সুস্থ হলেও তাদের কোনো না কোনোভাবে শারীরিক ক্ষতি হয়।
আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, আমাদের সচেতনতাই পারে এ ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখতে। তাই সবাইকে বলব খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে।
এ বছর নিপাহ আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, না, আমরা এখন পর্যন্ত আক্রান্ত কোনো রোগী পাইনি। তবে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে উপসর্গ নিয়ে অনেকেই পরীক্ষার জন্য আসেন।
নিপাহ ভাইরাস কী
ভাইরোলজির সংজ্ঞা অনুযায়ী, নিপাহ ভাইরাস একটা প্যারামিক্সো ভাইরাস। এনভেলপড ভাইরাস অর্থাৎ কোভিডের মতোই এর চারদিকে আবরণ থাকে, যেটা তৈলাক্ত।
আইইডিসিআর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮-৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। আর বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে, মেহেরপুর জেলায়।
কীভাবে ছড়ায়
আইইডিসিআর তথ্য মতে, প্রাকৃতিকভাবেই বাঁদুড়ের দেহে নিপাহ ভাইরাস থাকে। কিন্তু তারা নিজেরা আক্রান্ত হয় না। এই ভাইরাস কোনোভাবে মানুষের মধ্যে এলে মানুষ আক্রান্ত হয়। বাঁদুড়ের লালা ও প্রস্রাব থেকে ভাইরাস আসে খেজুরের কাঁচা রসে, সেখান থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায় নিপাহ ভাইরাস। খেজুরের কাঁচা রস ছাড়াও কোনো ফল যদি বাঁদুড় খায় সেই আধা খাওয়া ফল মানুষ খেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। বাঁদুড় ছাড়াও কোনো পাখি বা প্রাণীর আধা খাওয়া ফলও খাওয়া উচিত নয়।
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ
প্রচণ্ড জ্বর, তীব্র মাথা ব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মুখ দিয়ে লালা ঝরা, আবোল-তাবোল কথা বলা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে কাশির লক্ষণ পাওয়া গেছে। কাশিসহ যে লক্ষণ নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণে, সেটা বাংলাদেশে নতুন। এর মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
খেজুরের গুড় খেলে বা রস ফুটিয়ে খেলে নিপাহ ভাইরাস থাকে কি?
আইইডিসিআরের স্বাস্থ্য বার্তায় বলা হয়েছে, ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিপাহ ভাইরাস নষ্ট হয়। খেজুরের গুড় তৈরির সময় অনেক বেশি তাপমাত্রায় রস জ্বাল দিতে হয়, তাতে ভাইরাস থাকার কোনো আশঙ্কা থাকে না। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েসও নিরাপদ। তবে সঠিক তাপমাত্রায় জ্বাল দিয়ে খেতে হবে।
ওষুধ আবিষ্কার
নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধী কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। কোনো ভ্যাকসিনও তৈরি হয়নি। মস্তিষ্কের তীব্র প্রদাহের যে চিকিৎসা, নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিতদের জন্য একই চিকিৎসা। আইসিইউ সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে রোগীকে। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হবে। লক্ষণ দেখা দিলেই দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়
১. যেকোনো ফল খেতে হলে তা ভালোভাবে ধুয়ে শুকনো অবস্থায় খেতে হবে। কাঁচা সবজি দিয়ে সালাদ খেতে হলে সেগুলোকে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
২. কাঁচা খেজুরের রস কোনোভাবেই পান করা যাবে না।
৩. খেজুরের কাঁচা রসের সংস্পর্শে এলে হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে।
৪. মানুষ থেকে মানুষে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। সে জন্য কোভিডকালীন যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা— মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও দূরত্ব বজায় রাখা, তা অনুসরণ করতে হবে।
৫. কোনো ফাটা বা আধা খাওয়া ফল খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে এ ব্যাপারে শিশুদের দিকে নজর রাখতে হবে, যাতে কুঁড়িয়ে পাওয়া আধা খাওয়া পাকা ফল না খায়।
৬. খেজুরের গাছ কাটার সময় ঝুঁকি থাকে না, রস নামানোর সময় কিছুটা ঝুঁকি থাকে। যেহেতু রস নাড়াচাড়া করেন গাছিরা, সেজন্য ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, মুখে কাপড় বেঁধে নিতে হবে।
৭. ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাঁচা রস খাওয়ার প্রচলন ছাড়াও শীতকালে বিভিন্ন স্থানে রস উৎসব হয়। অনলাইনে রস বিক্রি হয় ভুল তথ্য দিয়ে, যেমন— নিরাপদ উপায়ে খেজুরের রস সংগ্রহ, জাল দিয়ে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা— এসব বন্ধ করা উচিত। শীতের সময় খেজুরের রস খেয়ে কেউ মারাত্মক অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য বাতায়ন হটলাইনে যোগাযোগ করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ নিতে হবে।