মুনিয়ার আত্মহত্যা : আনভীরের অব্যাহতি
কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া (২১) আত্মহত্যার প্ররোচণা মামলায় পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন আদালত। এর ফলে মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর।
আজ বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী এই আদেশ দেন। আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) মোহাম্মদ আলমগীর এনটিভি অনলাইনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার মুনিয়ার পরিবার পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজির আবেদন করেন মুনিয়ার বড় বোন ও মামলার বাদী নুসরাত জাহান।
আবেদনে বলা হয়, ‘মুনিয়ার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়নি। এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যও তদন্ত প্রতিবেদনে নেই। এ ছাড়া মুনিয়া যে বাসায় নিহত হয়েছেন সে বাসার সিসিটিভির ফুটেজের কোনো পর্যালোচনা করা হয়নি।’
গত ১৯ জুলাই কলেজছাত্রী মুনিয়ার আত্মহত্যা প্ররোচণার মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের (৪২) বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পুলিশ। ঢাকার সিএমএম আদালতে এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। তবে এ বিষয়ে ওইদিন কোনো আদেশ দেননি বিচারক।
গত ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বরে ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন।
মুনিয়া কুমিল্লা শহরের উজির দীঘিরপাড়ের প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমানের মেয়ে।
মামলার এজাহারে যা আছে : মুনিয়া মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। দুই বছর আগে মামলার আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকে তাঁরা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দেখা করতেন এবং সব সময় মোবাইলে কথা বলতেন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
২০১৯ সালে মুনিয়াকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আসামি রাজধানীর বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। সেখানে তাঁরা বসবাস করতে শুরু করেন। ২০২০ সালে আসামির পরিবার এক নারীর মাধ্যমে এই প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারে। এরপর আসামির মা মুনিয়াকে ডেকে ভয়ভীতি দেখান এবং তাঁকে ঢাকা থেকে চলে যেতে বলেন। আসামি কৌশলে তাঁর (বাদী নুসরাতের) বোনকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেন এবং পরে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাস দেন।
গত ১ মার্চ মুনিয়াকে প্ররোচিত করেন আসামি। তিনি বাসা ভাড়া নিতে বাদী নুসরাত ও তাঁর স্বামীর পরিচয়পত্র নেন। ফুসলিয়ে তিনি মুনিয়াকে ঢাকায় আনেন। তিনি গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কে বাসা (ফ্ল্যাট-বি-৩) ভাড়া নেন। ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে আসামি ও তাঁর (বাদীর) বোনের স্বামী-স্ত্রীর মতো ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখা হয়। আসামি বাসায় এলে কক্ষটি পরিপাটি করে রাখা হতো।
বোনের মাধ্যমে তিনি (মামলার বাদী) জানতে পারেন, আসামি তাঁকে বিয়ে করে বিদেশে স্থায়ী হবেন। কারণ, দেশে থাকলে আসামির মা–বাবা আসামিকে কিছু না করলেও তাঁর বোনকে মেরে ফেলবেন। গত ১ মার্চ থেকে আসামি মাঝেমধ্যে ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতেন।
গত ২৩ এপ্রিল মুনিয়া তাঁকে ফোন করে বলেন, আনভীর তাঁকে বকা দিয়েছেন। বলেছেন, কেন তিনি (মুনিয়া) ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছেন, ছবি তুলেছেন। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রীর বান্ধবী পিয়াসা দেখেছেন। তিনি তাঁর (আসামির) মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন।
আসামি মুনিয়াকে বলেন, তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন, সে যেন কুমিল্লায় চলে যায়। আসামির মা জানতে পারলে তাঁকে (মুনিয়া) মেরে ফেলবেন। দুদিন পর গত ২৫ এপ্রিল মুনিয়া তাঁকে (মামলার বাদী) ফোন করেন। ওই সময় তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, আনভীর তাঁকে বিয়ে করবেন না, শুধু ভোগ করেছেন। আসামিকে উদ্ধৃত করে মুনিয়া বলেন, আসামি তাঁকে বলেছেন, তিনি (মুনিয়া) তাঁর শত্রুর সঙ্গে দেখা করেছেন। মুনিয়াকে তিনি ছাড়বেন না। মুনিয়া চিৎকার করে বলেন, আসামি তাঁকে ধোঁকা দিয়েছেন। যেকোনো সময় তাঁর বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তারা (বাদী নুসরাতের পরিবার) যেন দ্রুত ঢাকায় আসেন।
নুসরাত তাঁর আত্মীয়স্বজন নিয়ে দুপুর ২টার দিকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় রওনা দেন। আসার পথে বারবার মুনিয়ার ফোনে ফোন করেন, কিন্তু তিনি আর ফোন ধরেননি। গুলশানের বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিচে নেমে আসেন। তারা নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে বাসার ইন্টারকমে ফোন করেন। পরে ফ্ল্যাটের মালিকের নম্বরে ফোন দিলে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার পরামর্শ দেন। মিস্ত্রি ডেকে তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর তিনি দেখেন, তাঁর বোন ওড়না পেঁচিয়ে শোয়ার ঘরের সিলিংয়ে ঝুলে আছেন।
পুলিশ এসে ওড়না কেটে মুনিয়ার মৃতদেহ নামায়। আলামত হিসেবে আসামির সঙ্গে ছবি, আসামির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখা ডায়েরি ও তাঁর ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোন নিয়ে যায় পুলিশ।