বাজেটের আগেই প্রতি শলাকায় সিগারেটের দাম বাড়ল এক টাকা!
শরিফুল ইসলাম রিকশাচালক। রিকশা চালানোর ফাঁকে দিনে অন্তত পাঁচ কাপ চা পান করেন তিনি। তবে, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কাপ চা দুই থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ তিনি। শুধু তিনি নন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। তাঁরা বলছেন, চায়ের দামের সঙ্গে বেড়েছে সিগারেটের দামও। অথচ, কোম্পানি না কি বাড়ায়নি। যদিও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থার কথা বলেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
হঠাৎ এই দাম বৃদ্ধিতে শরিফুলের মতো অনেকে এখন চান চা-সিগারেট ছেড়ে দিতে। তবে, অনেকদিনের অভ্যাস বলে ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে বলে দাবি তাঁদের।
রিকশাচালক শরিফুল বলেন, ‘হইহই করে সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সিগারেট না খেলেও হয়। এটা না হয় ছেড়ে দিলাম। কিন্তু, অন্য সব জিনিস তো প্রতিদিন লাগে। এগুলো সরকার দেখে না কেন?’
দামের বিষয়ে শরিফুলের দাবি যাচাই করতে বেশ কয়েকটি চা-সিগারেটের খুচরা ও পাইকারি দোকানে যান এ প্রতিবেদক।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আরাফাত টি স্টোরের মালিক দ্বীন মোহাম্মদ। তিনি প্রতিকাপ পাউডারের দুধ, তরল দুধ ও মাল্টার চা বিক্রি করছেন ১৫ টাকা দরে। অথচ, এক সপ্তাহ আগেও তিনি এ তিন প্রকার চা ১০ টাকা করে বিক্রি করতেন। প্রতি সলাকা সিগারেট বিক্রি করছেন আগের চেয়ে এক টাকা বেশি দরে।
দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘চা পাঁচ টাকা করে দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। শুধু আমি না, আশপাশের সব দোকানে একই হারে বেড়েছে দাম। দুধ ও চিনির দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। রং চায়ের দামও তিন টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। আর বেনসন, মালব্রো, গোল্ডলিফসহ অন্যান্য সিগারেটর দাম প্রতি শলাকায় এক টাকা করে বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ, প্রতি প্যাকেট সিগারেট ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে আমাদের।’
সাব্বির নামে আরেক দোকানি বলেন, ‘চায়ের দাম বাড়াতে হয়েছে। চিনি ও দুধের দাম বেশি। আর সিগারেটর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমার দোকানে প্রতিদিন সিগারেট লাগে ১০ প্যাকেট। কোম্পানি থেকে দিচ্ছে দুই প্যাকেট। ফলে, বেশি দামে বাইরে থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছি। বাজেট আসার আগেই সিগারেট কম দেওয়া শুরু করেছে কোম্পানি।’
দ্বীন মোহাম্মদ ও সাব্বিরের এ দাবি যাচাই করতে যাওয়া হয় কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের মকবুল ও বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরে।
মনোহরি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে মকবুল স্টোর। ওই দোকানের ম্যানেজার ফারুক হোসেন। তাঁর দাবি, কোম্পানি থেকে পর্যাপ্ত সিগারেট পাচ্ছেন না তিনি। ফলে, অন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
ফারুক হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এক প্যাকেট বেনসন ও মালব্রো সিগারেটের কোম্পানি রেট ২৭০ টাকা। কিন্তু, এখন ২৮০ থেকে ২৮৫ টাকা করে বিক্রি করছি। গোল্ডলিফ ২০৪ টাকা কোম্পানি রেট হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে ২১০ টাকা দরে। ডার্বি ও হলিউড ৮৫ টাকা বিক্রি করছি। আমার প্রতিদিন বেনসন ৩০ থেকে ৫০ কার্টুন প্রয়োজন হয়। কিন্তু, কোম্পানি থেকে আজ বৃহস্পতিবার দিয়েছে চার কার্টন। গোল্ডলিফ প্রয়োজন হয় ১৫ থেকে ২০ কার্টন, অথচ আজকে দেয়নি কোম্পানি। আর গত এক মাসে তিন ধরনের গুড়া দুধে অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কোম্পানি সিগারেটের দাম না বাড়ালেও স্টক যারা করেন, তাঁরা দাম বাড়িয়েছেন।’
এ দাম অনুযায়ী, বেনসন ও মালব্রোর ১৪ টাকা ২৫ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি সলাকা গোল্ডলিফের দাম পড়ছে সাড়ে ১০ টাকা।
বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরে শুধুই সিগারেট বিক্রি করা হয়। এটি কারওয়ান বাজারের সবচেয়ে বড় দোকান। এ দোকানের ম্যানেজার আব্দুর রহিম বলেন, ‘আপাতত কোম্পানি থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সিগারেট পাচ্ছি না। তাই, মৌলভীবাজার থেকে সিগারেট কিনছি। ওখান থেকে বেনসন ও মালব্রো প্যাকেটপ্রতি কিনছি ২৭৬ টাকা দরে। বিক্রি করছি ২৭৭ টাকা। অথচ, কোম্পানি রেট ২৭০ টাকা। গোল্ডলিফ ২০৮ টাকা প্যাকেটপ্রতি কিনছি। বিক্রি করছি ২০৯ টাকা। অথচ, কোম্পানি রেট ২০৪ টাকা। স্টার সিগারেট কিনছি ১২৮ টাকায়। বিক্রি করছি ১২৯ টাকা। অথচ, কোম্পানি রেট ১২৬ টাকা। হলিউড, ডার্বি ও পাইলট কিনছি ৭৯ টাকা। বিক্রি করছি ৮০ টাকা। অথচ, কোম্পানি রেট ৭৮ টাকা।’
ফারুক হোসেন ও আব্দুর রহিমের দাবি করা দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে আরাফাত টি স্টোরের মালিক দ্বীন মোহাম্মদ দাবি করেন, ‘তাঁরা মিথ্যা দামের কথা বলেছেন। ক্রেতা সেজে গেলে আরও দাম বেশি চাইতেন।’
দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘কিচেন মার্কেটের নিচ তলা থেকে আমার কাছ থেকে বেনসন ও মালব্রো সিগারেট নিয়েছে ২৮৫ থেকে ২৯০ টাকা। গোল্ডলিফ ২১২ টাকা করে নিচ্ছে।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কোম্পানির পক্ষ থেকে সিগারেট বিক্রি করেন রেজাউল নামের এক সেলসম্যান। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখন সিগারেট কম দিচ্ছি এটা ঠিক। কিন্তু, যারা আমার কাছ থেকে সিগারেট কেনেন, তারা কিন্তু বাইরে থেকেও কেনেন। তাঁরা বিক্রি করে টাকা বের করে আবার কেনেন। আমি তো আর সব সময় থাকি না। তাহলে এখন সমস্যা কী?’
সরকার কর্তৃক দাম বাড়ানোর আগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারেন কি না জানতে ভোক্তা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারকে বারবার চেষ্টার পরও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
পরে ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সিগারেটের দাম বেশি নিলে আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। যদিও এবার দাম বাড়ার জন্য এখনো আমরা অভিযোগ পাইনি। তবে, এ বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানানো হবে এবং এ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’