যেসব শর্তে বাংলাদেশকে ঋণ দেবে আইএমএফ
সরকার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সফররত প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের সংস্কার নীতিকে সহায়তা করতে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে একটি স্টাফ-পর্যায়ের সমঝোতায় পৌঁছেছে।
আজ বুধবার বাংলাদেশে সফরত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মধ্যে বৈঠকে বাংলাদেশকে ঋণ প্রদান, ঋণের শর্ত, প্রস্তাবিত ঋণের সুদ ও আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। বহু প্রত্যাশিত এ বৈঠক শেষে সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী ঋণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মন্ত্রী জানান, আইএমএফ তিন মাসের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবের সব আনুষ্ঠানিকতা এবং বোর্ড অনুমোদন সম্পন্ন করবে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি তিন দশমিক ৪৬৮ বিলিয়ন এসডিআর মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী এ ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণের প্রথম কিস্তি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে সব ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করেন অর্থমন্ত্রী।
এ ঋণের জন্য বাংলাদেশকে যেসব বিষয়ে সংস্কার করতে হবে তা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আইএমএফ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম কিস্তি ৩৫২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন এসডিআর অর্থ ছাড় করবে। বাকি ঋণ প্রতি ছয় মাস ৫১৯ মিলিয়ন এসডিআর হিসেবে ছয়টি সমান কিস্তিতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া যাবে।’
বর্তমান এসডিআর ইন্টারেস্ট রেট অনুযায়ী ঋণের গড় সুদহার দুই দশমিক ২০ শতাংশ বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ঋণের মোট তিনটি অংশ। এর মধ্যে প্রথম অংশের ৮২২ দশমিক ৮২ মিলিয়ন এসডিআরের জন্য কোনো সুদ দিতে হবে না। ঋণের বাকি অংশের মধ্যে এক হাজার ৬৪৫ দশমিক ৬৪ এসডিআরের সুদহার নির্ধারিত হবে এসডিআর ফ্লোটিং রেটের সঙ্গে এক শতাংশ যোগ করে। আর বাকি এক বিলিয়ন এসডিআরের সুদহার হবে এসডিআর ফ্লোটিং রেটের সঙ্গে দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে।
যা করতে হবে বাংলাদেশকে
আইএমএফের ঋণের জন্য সরকারের মূল লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আইএমএফের এই ঋণ কর্মসূচির জন্য অর্থনীতির বহিঃখাত স্থিতিশীল করা, ২০২৬ সালে এলডিসি হতে উত্তরণকে সামনে রেখে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেওয়া, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হবে, যা গত প্রায় ১৪ বছর যাবৎ আমরা করে আসছি। আমাদের সরকারের সবসময় প্রচেষ্টা থাকে বাজেট ঘাটতিকে জিডিপির পাঁচ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বছর আমাদের বাজেট ঘাটতি ছিল পাঁচ দশমিক এক শতাংশ, যা এই অর্থবছরে সাড়ে পাঁচ শতাংশ ধরা আছে।’
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে, যা আমরা প্রতি অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে আমাদের বরাদ্দ রয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন কয়েকটি আইন প্রণয়ন এবং পুরোনো কয়েকটি আইনের সংশোধনের চলমান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা, রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার জোরদার করাসহ কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা হবে। ভ্যাট আদায়ের জন্য আমরা ইএফডি মেশিন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। এ যাবৎ ছয় হাজার ৭৩২টি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। আগামী বছর আরও ৬০ হাজার মেশিন স্থাপন করা হবে এবং পরবর্তী চার বছরে দুই লাখ ৪০ হাজার মেশিন স্থাপিত হবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সঙ্গে সময়ে সময়ে সমন্বয় করা, যাতে সামনে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমলে দেশের অভ্যন্তরেও তা একইভাবে কমানো যায়।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের কাজটি ধীরে ধীরে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা, একটি দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়নের পরিকল্পনা করা, যার মধ্যে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার বিষয়টিও থাকবে।’