খুলেছে অধিকাংশ পোশাক কারখানা, বাড়তি নিরাপত্তার দাবি
মজুরির বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে বন্ধ হওয়া পাঁচ শতাধিক পোশাক কারখানার বেশির ভাগই শনিবার (৮ নভেম্বর) উৎপাদনে ফিরেছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পর শনিবার সকাল থেকে এসব কারখানা খুলে দেওয়া হয়৷ তবে কয়েকটি কারখানা খোলার পর সেখানে শ্রমিকরা গেলেও কাজে যোগ দেননি বলে জানা গেছে৷ আর শ্রমিক অসন্তোষের মুখে বন্ধ হওয়া ৪১টি কারখানা নানা কারণে খুলতে পারেননি মালিকেরা৷
এদিকে, শনিবার আশুলিয়া ও গাজীপুরে বিক্ষোভ করেছেন পোশাক শ্রমিকেরা৷ পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষও হয়েছে৷
কারখানা চালুর বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘বেশির ভাগ কারখানা খুলেছে৷ ৪১টি কারখানা খুলেনি৷ আশুলিয়ায় ৩৭টি, মাওনা এলাকায় তিনটি এবং মিরপুরে একটি কারখানা বন্ধ আছে৷’
বিজিএমইএ সভাপতি জানান, গত কয়েক দিনে পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল৷
নিরাপত্তার বিষয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘শ্রমিক-মালিক-কারখানা সবকিছুরই নিরাপত্তা দরকার৷ আমি মনে করি, নিরাপত্তাব্যবস্থা যতটুকু নেওয়া হয়েছে আমরা এই মুহূর্তে নিরাপত্তা বোধ করছি৷ কিন্তু আমরা মনে করি, আরও নিরাপত্তা দরকার, কারণ মালিকদের মধ্যে টেনশন রয়েছে৷’
মজুরির বাড়ানোর বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমরা চাই, যত তাড়াতাড়ি হোক মজুরিটা নির্ধারণ হয়ে যাক৷ সবাই মিলেই মজুরি নির্ধারণ করা হবে৷ মজুরি বোর্ড যে প্রস্তাব করবে, সরকার চাইলে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে৷’
ফারু হাসান বলেন, ‘সরকার যে মজুরি নির্ধারণ করে দেবে, আমরা কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে বলেছি, সেটাই আমরা মেনে নেব এবং ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হবে৷’
‘এখন তো অনেক সুবিধাবাদী আছে, পলিটিক্যাল আছে, লোকাল আছে, সবাই তার সুবিধাটা নিতে চায়৷ আমার মনে হয়, সবাই জানে কারা কীভাবে আন্দোলন করছে৷ আমাদের উদ্দেশ্য হলো ফ্যাক্টরি চালু রাখা, খোলা রাখা, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা৷ আমার নজর হলো শ্রমিকদের মজুরি ভালো করে বাড়ানো, তারা যেন খুশি থাকে এবং সন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করেন৷’
আশুলিয়া এবং গাজীপুরে বিক্ষোভ
এদিকে, বেতন বাড়ানোর দাবিতে শনিবার গাজীপুর সদরের গড়াগড়িয়া মাস্টারবাড়ির নতুন বাজার এলাকার বিক্ষোভ করেছেন এস এম নিট গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা৷ এ সময় পুলিশের তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় শ্রমিকদের ছোড়া ইটের আঘাতে শিল্প পুলিশের এএসপি এবং একজন পরিদর্শক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে৷
এ ছাড়া গতকাল শনিবার সকালে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার আবদুল্লাহপুর-বাইপাল সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন শ্রমিকেরা৷ পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং জলকামান দিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়৷ এই ঘটনায় কয়েকজন শ্রমিক আহত হয়েছেন৷
গাজীপুর শিল্প পুলিশের এসপি মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ‘শনিবার গাজীপুরের একটি কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন৷ শিল্প পুলিশ তাদেরকে সড়ক অবরোধ করতে দেয়নি৷ গত কয়েকদিনের থেকে পরিস্থিতি ভালো আছে৷ আমরা শ্রমিকদের বার্তা দিচ্ছি, সরকার তাদের দাবি বিবেচনা করছে৷ এই কাজে আমরা ফেডারেশনের নেতাদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছি৷’
আর আশুলিয়া শিল্প পুলিশের এসপি মো. শাখাওয়াত হোসেন মাঠে ঝামেলার মধ্যে আছেন জানিয়ে এ বিষয়ে কথা বলেননি৷
পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে গত এপ্রিলে নিম্নতম মজুর বোর্ড গঠন করে সরকার৷ এরপর মজুরি নির্ধারণে এই বোর্ড কাজ শুরু করে৷ গত ২২ অক্টোবর বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেন৷ আর মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়৷
এরপর ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকেরা৷ পরে তা আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার মিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে৷ অনেক জায়গায় শ্রমিকেরা ভাঙচুর শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্যায়ক্রমে পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
দেশে তৈরি পোশাক-সংশ্লিষ্ট কলকারখানা রয়েছে নয় হাজার ১৭৭টি৷ এসব কারখানায় ৪৩ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন৷ তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদরে ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ, সিডিপি৷
নাশকতা করলে ব্যবস্থা
শ্রমিক আন্দোলন পুঁজি করে কোনো ধরনের নাশকতা ও সহিংসতা করে পোশাক খাতকে নষ্ট করার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে র্যাব৷
শনিবার র্যাব-৪ সিপিসি-২ এর কার্যালয়ে পোশাক শ্রমিকদের চলমান আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা রোধে পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন, র্যাবের কার্যক্রম পর্যালচনা ও মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়ার পর এ কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন৷
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা গার্মেন্টস শিল্পকে নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করছে, তাদের অনেককে আমরা আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি৷ তাদের বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে৷ ভবিষ্যতে যারা এই শিল্প নিয়ে অরাজকতার চেষ্টা করবে, পেছন থেকে হোক বা মাঠ থেকে হোক তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে৷’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘যেখানে যেখানে গার্মেন্টস বেশি রয়েছে, সেই স্থানগুলোতে আমাদের র্যাবের টহল বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে আমরা যৌথ পেট্রোল করছি৷ যেকোনো ধরনের নাশকতা ও সহিংসতা রোধে আমাদের এই কার্যক্রম চলমান থাকবে৷’
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘যারা নাশকতা, সহিংসতার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷ গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় দুষ্কৃতকারীরা চোরাগুপ্ত হামলা থেকে সহিংসতা করছে৷ তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের আইনানুগ ব্যবস্থা চলমান রয়েছে৷’
শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
পোশাক শ্রমিকরা যাতে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান৷
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য শাজাহান খান বলেন, ‘গ্রহণযোগ্য মজুরি সবাই চায়৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে সব মজুরি বোর্ডেই শ্রমিকদের জন্য গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে৷ শ্রমিকদের জন্য ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টেরও ব্যবস্থা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ পোশাক শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার সুযোগ হয়ত প্রধানমন্ত্রী করে দেবেন, এ বিষয়ে তার চিন্তা আছে৷’
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে বোর্ড পাঁচটি সভা করেছে জানিয়ে শাজাহান খান বলেন, ‘৭ নভেম্বর আরেকটি সভায় মজুরি চূড়ান্ত হওয়ার কথা৷ এখন এই আন্দোলন করা অযৌক্তিক। এটা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে৷ শ্রমিকদের আহ্বান করব বিভ্রান্ত না হয়ে প্রকৃত বিষয়টি জানুন, এখনও মজুরি নির্ধারণ হয়নি৷ আগামী ৭ নভেম্বর বা এ মাসের মধ্যে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হবে৷ ১ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর করা হবে৷’
শাজাহান খান আরও বলেন, ‘কিছু লোক একটি আন্দোলনকে হঠকারী রূপ দেয় নিজের স্বার্থে বা রাজনৈতিক স্বার্থে৷ এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হস্তক্ষেপ আছে৷ কারণ নূন্যতম মজুরি বোর্ড যতবার হয়েছে, বিএনপি কোনো সময় ন্যূনতম মজুরির দাবি করেনি, এবার তারা সেই দাবি করেছে৷ আমি মনে করি, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে৷’
নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করার পরেও শ্রমিকদের আন্দোলন না-ও থামতে পারে বলে মনে করেন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান৷ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘কিছু লোক আছে উসকানি দেয়৷ তবে গ্রহণযোগ্য মজুরি ঘোষণা করা হলে সবাই পরবর্তীতে তা মেনে নেয়৷ তারপরেও অনেকে সেটা নিয়ে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করে৷’