কুয়েটে শিক্ষার্থীকে ‘ছাত্রলীগের মারধর’, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কর্তৃপক্ষের মামলা
হোয়াটসঅ্যাপে সরকারবিরোধী বার্তা আদান-প্রদান করায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সিএসই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমানকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বেদম পিটিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়েছে কুয়েট কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি রয়েছেন।
গত সোমবার গভীর রাতে কুয়েটের সিকিউরিটি অফিসার মো. সাদেক হোসেন প্রামানিক বাদী হয়ে খানজাহান আলী থানায় জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার আগে ড. এম এ রশিদ হলের প্রাধ্যক্ষ মো. হামিদুল ইসলাম ও সহকারী প্রাধ্যক্ষ সুনন্দ দাস উপস্থিত হয়ে ওই শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন পর্যালোচনা করেন। তাঁরা জানান, শিক্ষার্থীর ফোনে সরকারবিরোধী একটি গ্রুপে তার যুক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে এবং তার কক্ষ থেকে ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
পরে তারা খানজাহান আলী থানার পরির্দশক মো. কবির হোসেনকে ডেকে জাহিদুর রহমানকে সোপর্দ করেন।
খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন জানান, শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমান অসুস্থ থাকায় তাকে থানায় না নিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘১১ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় নিরাপত্তা প্রহরীর মাধ্যমে জানতে পারি, জাহিদুর রহমানকে একই হলের শিক্ষার্থীরা জঙ্গি/সরকারবিরোধী আখ্যা দিয়ে মারধর করে প্রভোস্ট রুমে আটকে রেখেছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মোবাইল ফোন পর্যালোচনা করে জাহিদুর রহমান আরেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ব্যক্তিগত চ্যাটে সরকারবিরোধী ও মানহানিকর মিথ্যা ও আক্রমণাত্মক তথ্য আদান-প্রদান করার প্রমাণ পাওয়া যায়।’
জাহিদের স্বজনেরা বলেন, গত রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টায় ড. এম এ রশিদ হলের গেস্ট রুমে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জাহিদকে ডেকে নিয়ে যায়। তাকে রাত ১১টা পর্যন্ত নির্মম ভাবে পেটানো হয়। ওই রাতেই পুলিশ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।
ওসি কামাল হোসেন বলেন, ‘জাহিদুর রহমান এবং রেজওয়ান স্যামের বিরুদ্ধে ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে আক্রমণাত্মক মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করে কুয়েট ছাত্রদের মধ্যে অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। জাহিদুর কুয়েট এবং স্যাম ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’
কুয়েট শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমান ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার সোনাপুর গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে। মামলার অপর আসামি রেজওয়ান স্যাম (২১) ভোলার বোরহানউদ্দিন মুশিরহাট গ্রামের বাসিন্দা।
কুয়েট ছাত্রলীগনেতা সাদমান নাহিয়ান সেজান বলেন, ‘ছেলেটি তাবলীগ জামাতের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু উগ্রবাদী বক্তব্য দেওয়ায় তাবলীগের লোকেরা ওদের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করে দেয়। ঘটনার রাতে ওর মোবাইলে সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে আপত্তিকর বক্তব্য পাওয়ায় সাধারণ ছাত্ররা মারধর করেছে বলে শুনেছি। সেখানে ছাত্রলীগের দু’একজন থাকতে পারে। তবে আমি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর আর মারধর হয়নি।’
জাহিদের বড় ভাই নাঈম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয়। আমার ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। ও কোনো সংগঠনে জড়িত না। জাহিদুর এটা করেছে আমার বিশ্বাস হয় না। যদি করেও থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাররা আছেন, হল প্রভোস্ট আছেন-তারা বিচার করবেন। এভাবে নির্মমভাবে পেটাবে কেন?’
কুয়েটের ড. এম এ রশিদ হলের প্রাধ্যক্ষ এম ডি হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছে জাহিদুর। এটা নজরে আসায় হলের ছাত্ররা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর আমরা তাকে পুলিশে সোপর্দ করি।’
মারধরের প্রসঙ্গে প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘আমার হাতে আসার পর কেউ মারধর করেনি। আগে কি হয়েছে জানি না।’
কুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিহির রঞ্জন হালদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘১১ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে হল প্রভোস্ট আমাকে ফোন করে জানায়, এক ছাত্রকে জঙ্গি সন্দেহে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে অন্য ছাত্ররা অল্প মারধর করেছে। আমি বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেই এবং তাৎক্ষণিক ছাত্রনেতাদের সতর্ক করেছি, যাই ঘটুক ছাত্রদের গায়ে যেন কেউ হাত না তোলে। ভবিষ্যতে হাত তুললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বর কুয়েটের ইইই বিভাগের প্রফেসর ড. সেলিম হোসেনকে লাঞ্ছিত করার পর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাঁর। এ ঘটনায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ৯ শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করা হয়। যার মধ্যে কুয়েট ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানও রয়েছেন। তবে বর্তমানে তারা সবাই ক্যাম্পাসে এবং হলে অবস্থান করে বলে অভিযোগ রয়েছে।