চলতি বছরে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে দেশজুড়ে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী, ৭৬ জন কলেজপড়ুয়া, ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এবং ৪৪ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।
আজ শুক্রবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনে এসব তথ্য তুলে ধরে। সংগঠনটি তাদের দেয়া তথ্যে উল্লেখ করে, আত্মহত্যাকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ। কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে ৪৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। মাদ্রাসাপড়ুয়াদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬০ দশমিক ৭১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।
আত্মহত্যাকারীদের অবস্থান বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। ঢাকায় গত ৮ মাসে শতকরা ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগে ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ১৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ এবং সিলেট বিভাগে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৭১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী এবং ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থী।
শিক্ষাস্তর বিবেচনায় দেখা গেছে প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিকপড়ুয়া ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। একই সময়ে ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী, ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এবং ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
চলতি বছরে প্রেমঘটিত কারণে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৫ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন। অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে চাওয়া পাওয়ার অমিল হওয়ায় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং পারিবারিক কলহের কারণে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। মানসিক সমস্যার কারণে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ, পড়াশোনার চাপে শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১ দশমিক ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। চুরির মিথ্যা অপবাদে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ১ দশমিক ৯২ শতাংশ, বিষাদগ্রস্ত হয়ে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং স্বামী পছন্দ না হওয়ায় ১ দশমিক ১০ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। তবে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশের আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছেন। মোটরবাইক, মোবাইল চেয়ে না পাওয়ার কারণে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে কিভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেক বড় ধরনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার ফলে অনেকের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। রাগ বেড়েছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙ্গে পড়ার হারও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে পড়াশুনার চাপও। এছাড়াও পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যাও বেড়েছে আগের চেয়ে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছেনা বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বেড়েছে। যেখানে আমরা আশা করেছিলাম করোনার পর আত্মহত্যা প্রবণতা কমে যাবে।'
আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, '৩৬৪ জনের আত্মহত্যা অনেক বড় একটি সংখ্যা। তাই এটিকে সংকট হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরকার, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিসহ প্রতিটা স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ জরুরি। সবাই যার যার জায়গা থেকে সচেতন হলে এ সমস্যা সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'আত্মহত্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে কোনো কারণগুলো আছে তা খুঁজে বের করে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবী। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে আত্মহত্যা না করলেও তাদের অন্যান্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। পেশাজীবীদেরও এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা উচিত এবং কী উদ্যোগ নেওয়া যায় সে বিষয়ে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।'
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের প্রস্তাবসহ আঁচল ফাউন্ডেশন সাত দফা প্রস্তাবনা পেশ করে।