ছাত্রলীগের অক্সিজেন পেল প্রায় সাত হাজার রোগী
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যখন রোগীরা অক্সিজেন সেবা পাচ্ছিলেন না, ঠিক সেই সময় বিনামূল্যে এই সেবার কাজে নিয়োজিত হন ছাত্রলীগের তিন নেতা। তাঁদের সেই মানবিক সেবা কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এক বছরের মাথায় এই সেবা পেয়েছেন প্রায় সাত হাজার রোগী।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। ওই বছরের ১৮ জুন তিন হাজার ৮০৩ জন নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে লাখ ছাড়িয়েছিল করোনার রোগী। ধীরে ধীরে মহামারি পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করে। দেশে দেখা দেয় কৃত্রিম অক্সিজেন সংকট। ভাইরাসে আক্রান্তেরা যাতে অক্সিজেনের অভাবে মারা না যায়, সে লক্ষ্যে গত বছরের জুনে রাজধানী ঢাকায় শুরু হয় এই তিন ছাত্রলীগ নেতার অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম। এর নাম দেওয়া হয় ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস’। যার স্লোগান ‘একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা’। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। উদ্যোক্তাদের বাকি দুজন হলেন ছাত্রলীগের বিজ্ঞান বিষয়ক উপ সম্পাদক সবুর খান কলিন্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক সদস্য রফিকুল ইসলাম সবুজ।
সেবার বিষয়ে প্রধান উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত বছর করোনাভাইরাস প্রকট আকার ধারণ করলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে অনেক মানুষ মারা যায়। ঠিক এই সময় বাজার থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার উধাও হয়ে যায়। নির্ধারিত মূল্য থেকে কয়েকগুণ বেশি দামেও পাওয়া যাচ্ছিল না অক্সিজেন। প্রতিটি মুমূর্তে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতেন রোগী ও স্বজনেরা। সেই মুমূর্ষ রোগীর সেবা দিতে আমরা বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিতে শুরু করি। প্রায় এক বছরের কাছাকাছি হতে চলল। আমরা যখন এটি শুরু করি তখন আমাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কাছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবাটি পৌঁছে দেয়া। এমনকি সিলিন্ডার বাবদ কোনো জামানতও আমরা নেই না।’
গত বছরের জুনে রাজধানীতে এই সেবা শুরু হলেও পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম ও মংমনসিংহ বিভাগে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় এই সেবা দেওয়া হয়। যদিও এখন প্রায় ১৪০ জন স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে সারা দেশে এই সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
কোনো মূল্য ছাড়াই দিনের ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাত দিন এই সেবা দেওয়া হয়। এমনকি কোনো রোগীকে জামানত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য নেওয়া হয় না যাতায়াত ভাড়াও। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখালেই এই সেবা দেওয়া হয়। কার্যক্রমের শুরুতে সেবা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিলিন্ডার ফেরত দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এখন তা বাড়ানো হয়েছে। রোগীর যত দিন প্রয়োজন তত দিন তারা সিলিন্ডার ব্যবহার করতে পারবেন বলে জানান উদ্যোক্তারা।
সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো সিলিন্ডার হারায়নি, আমাদের কোনো ধোঁকা খেতে হয়নি। চারদিকে একে অপরকে ঠকানোর এত প্রতিযোগিতার মধ্যে আমরা ঠকিনি একবারও। আসলে এত সুন্দরভাবে মানুষের সাড়া পেয়েছি, যা বলার বাইরে। দিন শেষে মানুষের ভালবাসা এবং বিশ্বাসই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’
উদ্যোক্তাদের মতে, ২০ জন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ১৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক এই মানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন। কার্যক্রমের প্রথম ছয় মাসে তাদের থেকে সেবা নিয়েছেন তিন হাজার ২৪২ জন। আর পরের ছয় মাসে সেই সংখ্যা পৌঁছে যায় প্রায় সাত হাজারে।’
অ্যাজমা-শ্বাসকষ্টে ভোগা শাহ নেওয়াজের বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনীম আফরোজ শায়েমা বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার বোন অ্যাজমা-শ্বাসকষ্ট সমস্যায় ভুগছিল। তখন চিকিৎসক অক্সিজেনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু, আমার বাসা রংপুরের পীরগঞ্জে হওয়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট ছিল। এমতাবস্থায় আমার বন্ধুর মাধ্যমে জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিসের প্রধান সাদ বিন কাদের ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সমস্যার কথা বললে তিনি তাৎক্ষণিক অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে দেন। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
তানভীর রহমান নামের আরেক রোগী বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলাম। অবস্থা এতটা খারাপ ছিল, মনে হচ্ছিল যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছি। এ সময় অক্সিজেন নেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে। এ সময় সাদ বিন কাদের ভাইকে কল করলে তাঁর স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে রাত একটার দিকে আমাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেন।’
সেবা দিতে গিয়ে গত বছরের অক্টোবরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন সাদ বিন কাদের ও সবুর খান কলিন্স। একই সময় সাদ বিন কাদেরের পরিবারের সদস্যেরাও আক্রান্ত হন। কিন্তু থেমে থাকেননি তারা। মানবিক কার্যক্রমে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন এখনো পর্যন্ত।
সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘দেশের যেকোনো জায়গা থেকে ফোন করলেই আমরা এই সেবা দিচ্ছি। রোগীদের থেকে আমরা ব্যাপকভাবে সাড়া পাচ্ছি। তাঁদের প্রয়োজন শেষ হলে তাঁরা ঠিকমতো আমাদের কাছে সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ। তাঁদের জীবন এবং পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেও তাঁরা এই মানবিক সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবারের দোয়া ও ভালোবাসা আমাদের কাজ করতে অনুপ্রাণিত করছে। মানুষের জন্য কাজ করার সময় ও সুযোগ সবসময় আসে না। যতদিন এই পরিস্থিতি চলবে ততদিন আমরা এই কার্যক্রম চলমান রাখবো।’
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘করোনার সময় দেশের মানুষকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। আমরা এই সেবার উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরীসহ অন্য যাঁরা আছেন, সবার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তাদের জন্য সবসময় আমাদের সহযোগিতা থাকবে।’