জবির আইন বিভাগেই মানা হচ্ছে না আইন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) আইন অমান্য করে টানা চার বার চেয়াম্যানের পদ ধরে রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাস । ১২ বছর ধরে চেয়ারম্যান পদে নিয়োজিত থাকার পর পঞ্চম বারের মতো আবার চেয়ারম্যান হয়েছেন তিনি । এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে চেয়ারম্যান থাকায় স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব তৈরি হয়েছে । আইন বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে একজন অধ্যাপকের পদ ফাঁকা থাকলেও আধিপত্য ধরে রাখতে অধ্যাপক নিয়োগের জন্য কখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে চাহিদাপত্র দেননি তিনি।
জানা যায়, ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই বর্তমান সময় পর্যন্ত একাধারে ১২ বছর ধরে আইন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ড. সরকার আলী আক্কাস। বর্তমানে আইন বিভাগে আরও দুইজন সহযোগী অধ্যাপক আছেন কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কাউকেই এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বলা হয়েছে, ‘বিভাগে অধ্যাপক না থাকলে সহযোগী অধ্যাপককে চেয়ারম্যানশিপ দিতে হবে।’ কিন্তু তিনি নিজেই বিভাগের অধিপত্য ধরে রাখার জন্য চেয়ারম্যান পদ ধরে রেখেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (২০০৫) এর ২৪ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা আছে, ‘বিভাগীয় অধ্যাপকদের মধ্য হইতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে তিন বৎসর মেয়াদে ভাইস-চ্যান্সেলর কর্তৃক বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিযুক্ত হইবেন। ২৪ নম্বর ধারার ৩ নম্বর উপধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনো বিভাগে অধ্যাপক না থাকেন তাহা হইলে ভাইস-চ্যান্সেলর সহযোগী অধ্যাপকদের মধ্য হইতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে একজনকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিযুক্ত করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, সহযোগী অধ্যাপকের নিম্নের কোনো শিক্ষককে বিভাগীয় চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করা যাইবে না। আরও শর্ত থাকে যে, অন্যুন সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার কোনো শিক্ষক কোনো বিভাগে কর্মরত না থাকিলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রবীনতম শিক্ষক উহার চেয়ারম্যান হইবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুযায়ী, ‘বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক থাকায় তিনি পুনরায় বিভাগের চেয়ারম্যান হতে পারেন না।’ কিন্তু ড. সরকার আলী আক্কাস আইন অমান্য করে পুনরায় বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন।
এদিকে পর পর দুই মেয়াদে ডিনের দায়িত্ব পালনের নিয়ম না থাকলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ভঙ্গ করে পর পর তিনবার ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালের ৯ মে থেকে ২০১৮ সালের ৮ মে পর্যন্ত ডিনের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চতুর্থবার ডিন হতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক খ্রিস্টান রিচার্ডসন উপাচার্য বরাবর অভিযোগ করলে সরকার আলী আক্কাস ডিন হতে ব্যর্থ হন । পরবর্তীতে দুই বছর পরে চতুর্থবার পুনরায় তিনি ডিন হিসেবে দায়িত্ব পান। বিশ্ববিদ্যালয় আইনের (২০০৫) ২২ নম্বর ধারার ৫ নম্বর উপধারায় বলা আছে, ‘ভাইস-চ্যান্সেলর সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে প্রত্যেক অনুষদের জন্য উহার বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপকদের মধ্য হইতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে দুই বৎসর মেয়াদের জন্য ডিন নিযুক্ত করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ডিন পরপর দুই মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হইতে পারিবেন না। আরও শর্ত থাকে যে, কোনো বিভাগে অধ্যাপক না থাকিলে সেই বিভাগের জ্যেষ্ঠতম সহযোগী অধ্যাপক ডিন পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হইবেন এবং কোনো বিভাগের একজন অধ্যাপক ডিনের দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে ওই বিভাগের পরবর্তী পালাসমূহে অবশিষ্ট অধ্যাপকরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ডিন পদে নিযুক্তির সুযোগ পাইবেন। আরও শর্ত থাকে যে, একাধিক বিভাগে সমজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপক থাকিলে সেক্ষেত্রে তাহাদের মধ্যে ডিন পদের আবর্তনক্রম ভাইস-চ্যান্সেলর কর্তৃক নিদিষ্ট হইবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, আইন অনুষদের দুই বিভাগে আরও তিনজন সহযোগী অধ্যাপক থাকার পরেও নিয়ম অনুযায়ী তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ না দিয়ে সরকার আলী আক্কাসকে আবারও চতুর্থবারের মতো ডিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ১৭ (২) ধারায় সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল দায়িত্বের জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করা যাইবে সেই সকল দায়িত্বের মধ্য হইতে একসঙ্গে একাধিক দায়িত্ব কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে প্রদান করা যাইবে না।’ এক্ষেত্রেও সরকার আলী আক্কাস আইন অমান্য করেছেন। একইসঙ্গে তিনি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ বিষয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগের চেয়ারম্যান খ্রিস্টান রিচার্ডসন বলেন, ‘এ আইন অনুষদের ডিন বিষয় নিয়ে আমি একবার অভিযোগ করেছিলাম, তখন বিষয়টি সমাধান করেছিলেন উপাচার্য স্যার। যেহেতু এটা বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়, শিক্ষকরা চাইলেই সমাধান করতে পারবেন।’
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাস বলেন, ‘নিয়োগতো আমি দেই না, বিশ্ববিদ্যালয় দেয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় আইন মেনেই নিয়োগ দেয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে এভাবেই চলছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তিনি চেয়ারম্যান হয়েছেন। সহযোগী অধ্যাপক থাকার পরেও তিনি কিভাবে চেয়ারম্যান হলেন? জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর থাকলে তিনিই চেয়ারম্যান হবেন।’ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ২৪ নম্বর ধারার ২ ও ৩ উপধারার কথা বললে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে জানান।