ঢাবির ক্যান্টিনে দাম বাড়লেও বাড়েনি খাবারের মান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হলগুলোর ক্যান্টিনে সব খাবারের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে, কমতে শুরু করেছে মান। বারবার অভিযোগের পরও নীরব ভূমিকায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সম্প্রতি হলের ক্যান্টিনগুলোতে দেখা যায়, আগে মুরগির মাংস ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন তা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা করা হয়েছে। ৩ থেকে ৩৫ টাকায় যেখানে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া যেত, তা এখন বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। গরুর মাংস ৪৫ থেকে ৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
আগে ডিম দিয়ে ভাত খেতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা লাগলেও এখন তা ৪০ ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া ক্যান্টিনের চেয়ে একটু ভাল মানের খাবারের জন্য ক্যাম্পাস ও হলের বিভিন্ন খাবারের দোকানগুলোতে গেলে গুনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৭৫ বা ৮০ টাকা পর্যন্ত।
তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খাবারের দাম বৃদ্ধি পেলেও মান নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানের খাবারের দোকানগুলোতে নিয়মিত নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এ সব খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে ভোগেন পেটের নানা সমস্যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের ক্যান্টিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্যান্টিনের রান্নাঘরগুলোতে অস্বাস্থ্যকর ও সেঁতসেঁতে পরিবেশে খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া বা দোকানগুলোতে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশই শিশু, যাদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে নেই কোনো ন্যূনতম ধারণা। আর এসব জায়গায় রান্নায় ব্যবহার করা হচ্ছে খুবই নিম্নমানের তেল, টেস্টিং সল্টসহ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপকরণ।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন, এসব ক্যান্টিনে বাজারের সবচেয়ে কম দামের ও নষ্ট জিনিসগুলোই নিয়ে আসা হয়।
আর এখানে পরিবেশিত খাবারগুলোতে বিভিন্ন সময় ধাতব উপাদান ও পোকামাকড়সহ নানা ধরনের ময়লা পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই। এমনকি, মাছ ধরার বড়শিও পাওয়া গেছে বলে আছে অভিযোগ।
গত ১২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ক্যান্টিনে রান্না করা খাবারে পাওয়া যায় ওই বড়শি। গত ৩১ অক্টোবরও এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে সেখানে। গত ২৪ অক্টোবর, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের এক শিক্ষার্থীও খাওয়ার সময় তরকারিতে বড়শি পান।
গত ১১ সেপ্টেম্বর মাস্টার দ্যা সূর্যসেন হলের একটি দোকানে দুর্গন্ধযুক্ত পঁচা মাংস ও বাসি খাবার খাওয়ানোর অভিযোগে দোকানটি বন্ধ করে দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। কিছুদিন পর অবশ্য শর্তসাপেক্ষে দোকানটি হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে চালুর অনুমতি দেওয়া হয়।
গত ২৬ আগস্ট পল্লী কবি জসীম উদ্দীন হলের ক্যান্টিনে ভাতে পোকা, মুরগির মাংসের তরকারিতে পালক, পচা ডাল এবং দুর্গন্ধযুক্ত তরকারি
পরিবেশনের অভিযোগে ক্যান্টিনে তালা ঝুলিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান হলের ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের ব্যাপার হল প্রশাসনের নজরে আসে।
এ ব্যাপারে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থী নাবিল হাসান বলেন, ‘এরকম অস্বাস্থ্যকর খাবার দীর্ঘদিন ধরে খাওয়ার ফলে প্রায়ই পেটের সমস্যা অনুভব করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হলের খাবারের মান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো—ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যান্টিনে ফাও (বিনামূল্যে) খান। ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষ ফাও খাওয়ার টাকা ব্যালেন্স করতে গিয়ে খাবারের মান কমিয়ে দিচ্ছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এদের বেশিরভাগই এখন পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তা ছাড়া, হল প্রশাসনের উদাসীনতাও রয়েছে। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘দাম হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনগুলোতে মানসম্মত খাবার দেওয়া হচ্ছে না, এটা সত্য। এ ছাড়া ন্যূনতম বা ন্যায্য মূল্যেও খাবার নিশ্চিত করা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমরা বারবার আহ্বান জানিয়েছি যে, বৈশ্বিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে কিছু শিক্ষার্থীকে রেশনিংয়ের মাধ্যমে খাবার দেওয়াসহ এবং ক্যান্টিনগুলোতে ভর্তুকি দিয়ে মানসম্মত খাবার যেন নিশ্চিত করা হয়। কারণ, এখানে নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া করে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘বাসি এবং পঁচা খাবার কখনোই দেওয়া উচিত না। ব্যাকটেরিয়াযুক্ত এ খাবার পেটে বিভিন্ন ধরনের অসুখের কারণ হতে পারে। আর পোকামাকড় ও অন্যান্য ময়লাসহ যেন খাবার রান্না ও পরিবেশন কোনোভাবেই না করা হয়, সেজন্যও প্রতিটি হলের প্রাধ্যক্ষের উচিত নিয়মিত ক্যান্টিনে তদারকি করা।’