সতেরো পেরিয়ে আঠারোয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
অর্জনে গৌরবে সতেরো পেরিয়ে বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) আঠারোতে পা রাখতে যাচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ১৭ বছর পূর্ণ হলেও এর ইতিহাস শুরু হয় ১৮৫৮ সাল থেকে। ১৬৪ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য ও সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর তখন থেকেই কর্তৃপক্ষ ২০ অক্টোবর দিনটি বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস
১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু করেন প্রয়াত জগন্নাথ রায়চৌধুরী। ১৮৭২ সালের দিকে নাম বদলে করা হয় জগন্নাথ স্কুল। ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ রায়চৌধুরীর ছেলে কিশোরীলাল রায়চৌধুরী এটিকে কলেজে উন্নীত করেন। তখন জগন্নাথ কলেজ নামে নামকরণ করা হয় প্রতিষ্ঠানটির। পরবর্তীতে ১৮৮৭ সালে শিক্ষা বিভাগের নির্দেশে স্কুল ও কলেজ শাখা আলাদা করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পর জগন্নাথ কলেজে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়। তখন এর নাম ছিল জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। পুরান ঢাকায় নারী শিক্ষায় বাঁধা দূর করতে ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজ সহশিক্ষা চালু করে। ১৯৪৮ এর দিকে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৮ বছর পর ১৯৪৯ সালে এ কলেজ আবার স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন এখানে। ১৯৬৮ সালে তখন কলেজটিকে সরকারি করা হলেও পরের বছর আবার এটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় ফিরে যায়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে এখানে স্নাতকোত্তরও চালু হয়। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে এ সরকারি কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মধ্য দিয়ে এটি পূর্ণাঙ্গ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটের অধীনে ১৪ হাজার ৮৭৬ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এছাড়াও এমফিলে ২৪৫ জন ও পিএইচডিতে ১৪১ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এখন পর্যন্ত জবিতে ৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হন। বর্তমানে ৩ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি বিভাগে প্রফেশনাল প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, আরও বেশ কয়েকটি বিভাগে চালুর প্রস্তুতি চলছে। এখানে ৬৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬৭৮ জন শিক্ষক রয়েছে। যার মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন ১৪৪ জন। তন্মধ্যে গ্রেড ১ এর ৩৫ জন ও গ্রেড ২ এর ৪৮ জন। এছাড়াও সহযোগী অধ্যাপক ১৭৭ জন, সহকারী অধ্যাপক ২৯০ জন ও প্রভাষক ৬৭ জন।
নতুন ক্যাম্পাস
নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণে বর্তমান ক্যাম্পাস থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কেরাণীগঞ্জের তেঘরিয়ায় ২০০ একর চিহ্নিত করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মোট বাজেট নির্ধারণ করা হয় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। দুই বছরের এ প্রকল্পের মেয়াদ পরে বাড়ানো হয় আরও দুই বছর। তবে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ শেষ হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এদিকে ২০০ একর জায়গার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৮৮ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে, নানা জটিলতায় আটকে আছে বাকি ১২ একর অধিগ্রহণের কাজ। আর তাই জমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ না হওয়ায় সীমানাপ্রচীরের কাজও আটকে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন ক্যাম্পাসের কাজ হতে আসলেই দেরি হয়ে গেছে। এখন কীভাবে দ্রুত করা যায়, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ওনাকে জানাবো।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
নানা সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা আবাসিক সমস্যা। পুরান ঢাকার মেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে এখানকার শিক্ষার্থীরা। তবুও গবেষণা, চাকরির বাজারে অনেকটাই এগিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এনটিভি অনলাইনকে নিজেদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া কথা বলেন, আগে তো মেসে থাকতাম। তবে এখন ছাত্রী হলটি খুলে দেওয়ায় অনেক সুবিধা হয়েছে। এজন্য প্রশাসনকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। তবে এখনও অনেক শিক্ষার্থী কষ্ট করে মেসে থেকে পড়াশোনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত দ্রুত নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষ করে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ওসমান বলেন, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের বেশি সংগ্রাম করে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হয়। কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন চাকরির বাজারে অনেক এগিয়ে। গবেষণাও করছে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্যের চিন্তা-ভাবনা
গত বছরের ১ জুন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক। ১৮ বছরে পা দেওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পাওয়ায় সম্মানিত বোধ করে এ উপাচার্য এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। এটি আমার জন্য সম্মানেরও বটে। পূর্ণ যৌবনে পা রাখা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি উচ্চমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার চেষ্টা করছি। শিক্ষা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিতে চাই প্রতিষ্ঠানটিকে। অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে নয়, নিজের স্বকীয়তায় এ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে।
নতুন ক্যাম্পাসের পরিকল্পনা নিয়ে উপাচার্য বলেন, নতুন ক্যাম্পাসের মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে জটিলতা ছিল। সেটি পুনরায় তৈরি করা হয়েছে। এখন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তা পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই আমরা চূড়ান্ত করে কাজ শুরু করবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবীমার অধীনে আনার চিন্তা-ভাবনাও চলছে বলে জানান উপাচার্য ইমদাদুল হক।
শিক্ষার্থী নেতৃত্বগুণকে বিকশিত করতে জকসু নিয়ে উপাচার্যের পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জকসু হলেই যে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে বিষয়টি এমন নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে শিক্ষার্থীরাই। সেখান থেকেই তাদের নেতৃত্ব গুণ বিকশিত হচ্ছে। তবে জকসুর বিষয়ে আমি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করবো।